ইবনে খালদুনের মতে রাষ্ট্রের উত্থান-পতনে কয়টি পর্যায় পরিলক্ষিত হয়?
A
৪টি
B
৫টি
C
৬টি
D
৭টি
উত্তরের বিবরণ
ইবনে খালদুনের রাষ্ট্র তত্ত্ব তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Muqaddimah-এ বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে, যেখানে তিনি রাষ্ট্রকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রেরও একটি জীবনচক্র রয়েছে — জন্ম, বিকাশ, স্থিতি, অবক্ষয় ও পতন। এই প্রক্রিয়াটি পাঁচটি ধাপে সম্পন্ন হয় এবং প্রতিটি ধাপ রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থার পরিবর্তনকে নির্দেশ করে।
রাষ্ট্র পরিবর্তনের পাঁচটি ধাপ:
১. প্রথম পর্ব — উত্থান ও সংহতির যুগ:
এই পর্যায়ে শাসক ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে গোষ্ঠী সংহতি (Asabiyyah) অত্যন্ত শক্তিশালী থাকে। তারা সাহস, ঐক্য ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে শত্রু পরাস্ত করে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। জনগণ ও শাসকের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা বিদ্যমান থাকে। রাষ্ট্র ক্রমে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।
২. দ্বিতীয় পর্ব — ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ:
এই পর্যায়ে শাসকগণ সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জন করে এককভাবে শাসন চালাতে শুরু করে। জনগণের মতামত ও অধিকার উপেক্ষিত হয়। শাসন পরিবারভিত্তিক হয়ে যায় এবং গোষ্ঠী সংহতি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। নগর সভ্যতার প্রভাবে বিলাসিতা ও স্বার্থপরতা বাড়ে।
৩. তৃতীয় পর্ব — ভোগ-বিলাস ও স্থবিরতা:
এটি ভোগ-বিলাসের যুগ। শাসক রাজনীতি ও প্রশাসনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশে নিমগ্ন হয়। তিনি স্মৃতিস্তম্ভ, প্রাসাদ ও কীর্তি নির্মাণে বেশি মনোযোগ দেন। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সামরিক শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। এই সুযোগে নতুন গোষ্ঠী বা শক্তি রাষ্ট্র দখলের সুযোগ পায়।
৪. চতুর্থ পর্ব — অনুকরণ ও দম্ভের যুগ:
এই সময়ে শাসকগণ পূর্বপুরুষদের পথ অনুসরণ করার ভান করে কিন্তু প্রকৃত নেতৃত্বগুণ হারিয়ে ফেলে। তারা শত্রু-মিত্র উভয়ের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে চায়, অথচ নিজের জাতিগত গৌরবে দম্ভিত থাকে। নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয় এবং রাষ্ট্রের গতিশীলতা হারিয়ে যায়।
৫. পঞ্চম পর্ব — পতন ও অবক্ষয়:
এই পর্যায়ে রাষ্ট্রে দুর্নীতি, বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতা চরমে পৌঁছে যায়। শাসকরা সাহস ও শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলে। প্রশাসনে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়, যার ফলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, সৈন্যদের বেতন বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এভাবেই রাষ্ট্রের পতন ঘটে।
বিশ্লেষণ:
ইবনে খালদুনের এই তত্ত্ব আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি প্রথম রাষ্ট্রের উত্থান ও পতনকে সামাজিক সংহতি (social cohesion) ও নৈতিকতার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাজনীতির এক সমন্বিত বিশ্লেষণ হিসেবে আজও প্রাসঙ্গিক।

0
Updated: 1 day ago