বাংলা সাহিত্যে সনেট রচনার সূচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ঘটনা, যা আধুনিক কাব্যরীতিকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনার কৃতিত্ব যিনি অর্জন করেন তিনি হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব গ্রহণ করে বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সূচনা করেন, যার ফলস্বরূপ বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয় বৈচিত্র্য ও রূপগত পরিশীলনে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি ও ইউরোপীয় সাহিত্যের গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন। ইতালীয় কবি পেত্রার্ক ও ইংরেজ কবি মিলটন-এর সনেট রচনার ধারা থেকে তিনি অনুপ্রাণিত হন। পশ্চিমা ছন্দ ও কাঠামোকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা ছিল একটি কঠিন কাজ, কিন্তু মাইকেল তার অসাধারণ দক্ষতা ও ভাষাবোধ দিয়ে তা সফলভাবে সম্পন্ন করেন। এর ফলে বাংলা কাব্যে একটি নতুন রীতির সূচনা ঘটে।
তিনি প্রথম সনেট রচনা করেন ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামক গ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ৭২টি সনেট সংকলিত হয়েছিল, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম সনেটগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এই সনেটগুলোতে দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, প্রকৃতিপ্রেম, ধর্ম, প্রেম ও দার্শনিক চিন্তার মতো নানা বিষয় স্থান পেয়েছে। মাইকেল শুধু সনেটের কাঠামোই অনুসরণ করেননি, বরং এর মাধ্যমে তিনি বাঙালি সমাজের ভাবনা ও অনুভূতিকে শিল্পরূপে প্রকাশ করেছেন।
তার সনেটগুলোতে চতুর্দশ পঙ্ক্তির বিন্যাস, অন্ত্যমিলের সূক্ষ্ম ব্যবহার, এবং ভাবগত ঐক্য স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। তিনি বাংলা ভাষায় ইতালীয় ও ইংরেজি সনেটরীতির মিশ্রণ ঘটান, যা তাকে বাংলা সনেটের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। তার সনেটগুলোতে দেখা যায় উচ্চ ভাবধারা ও গভীর ভাবুকতা, যা বাংলা সাহিত্যে আগে দেখা যায়নি।
মাইকেল মধুসূদনের সনেট কেবল একটি সাহিত্যরীতি নয়, বরং এটি ছিল আধুনিক বাঙালি চেতনার প্রতিফলন। তিনি প্রমাণ করেন যে বাংলা ভাষা শুধু সহজ কবিতা নয়, বরং জটিল ও পরিশীলিত কবিতার মাধ্যমও হতে পারে। তার এই সৃষ্টিশীল প্রয়াস পরবর্তী কবিদের, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার ও জীবনানন্দ দাশের মতো কবিদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
অতএব, বাংলা সাহিত্যে সনেট রচনার প্রবর্তক হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর নাম সর্বজনস্বীকৃত। তার উদ্যোগেই বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় রীতির সার্থক প্রয়োগ ঘটে, যা বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের ভিত্তি স্থাপন করে।