সংস্কৃতি বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও উপাদান সমূহ লিখ।

Avatar

Shihabur Rahman

Academic

সংস্কৃতি বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও উপাদান সমূহ লিখ। 

ভূমিকা: সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনযাত্রার অভ্যাস, বিশ্বাস, রীতিনীতি ও আচরণের সমষ্টি। এটি একটি সমাজের জীবনধারা ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ, বিশেষ করে গ্রামীণ সংস্কৃতি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, তাই গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে,

এডওয়ার্ড বি. টাইলর (1832-1917) বলেন, “সংস্কৃতি হলো জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্প, নৈতিকতা, আইন, রীতিনীতি ও সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের অর্জিত অন্য সব সক্ষমতার সমষ্টি।”

ক্লাইড ক্লুকহোনের (1905-1960) মতে, “সংস্কৃতি হলো সমাজে প্রাপ্ত চিন্তার ধারা, আচরণ, রীতিনীতি ও মূল্যবোধের সমষ্টি।”

রালফ লিনটন (1893-1953) বলেন,সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনযাত্রার এক নির্দিষ্ট পদ্ধতি।”

 

বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও উপাদান: বাংলাদেশের গ্রামীন সাংস্কৃতির ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ । নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো ;

 

১. ভাষা ও লোকসাহিত্য: বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বাংলা ভাষার একটি সহজ-সরল রূপ প্রচলিত। অঞ্চলভেদে ভাষার কিছু পার্থক্য দেখা যায়। লোকসাহিত্য এই সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুঁথি পাঠ, পালাগান, কিচ্ছাগান, লোকগল্প, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা ইত্যাদি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।

 

২. কৃষিনির্ভর জীবনধারা: গ্রামীণ অর্থনীতি প্রধানত কৃষিভিত্তিক। ধান, পাট, গম, সবজি ও ফলমূল উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত নানা উৎসব যেমন নবান্ন, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি গ্রামীণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

৩. পোশাক ও অলঙ্কার: গ্রামবাংলার মানুষ সাধারণত সাদামাটা ও আরামদায়ক পোশাক পরিধান করে। পুরুষরা লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিধান করে, আর নারীরা শাড়ি। নারীরা তাদের ঐতিহ্যের পরিচায়ক হিসেবে চুড়ি, নূপুর, হার ইত্যাদি অলঙ্কার ব্যবহার করে।

 

৪. লোকসংগীত ও নৃত্য: গ্রামবাংলার সংস্কৃতিতে বাউলগান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মারফতী ও মুর্শিদি গান বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এ ছাড়া জারি-সারি গানও প্রচলিত। নাচের মধ্যে গম্ভীরা, ঝুমুর ও ধামাইল নাচ উল্লেখযোগ্য। এগুলো গ্রামবাংলার উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলে। 

 

৫. মেলা ও উৎসব: গ্রামের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম গ্রামীণ মেলা। বৈশাখী মেলা, মধুমেলা, কারুশিল্প মেলা, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি গ্রামের মানুষের জীবনের অংশ। এসব মেলায় হস্তশিল্প, মাটির তৈরি জিনিসপত্র ও ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায়।

 

৬. খাবার ও রান্নার ধরন: গ্রামীণ মানুষের খাবারে সাদামাটা ও পুষ্টিকর খাবার দেখা যায়। ভাত, ডাল, মাছ, শাকসবজি প্রধান খাবার। গরম ভাতের সঙ্গে সরষে ইলিশ, শুঁটকি, পান্তা ভাত ইত্যাদি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার। উৎসবের দিনে পায়েস, পিঠা, দই, নাড়ু ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

 

৭. সমাজব্যবস্থা ও সম্পর্ক: গ্রামবাংলার সমাজব্যবস্থা পরিবারকেন্দ্রিক। যৌথ পরিবার প্রচলিত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার রীতি রয়েছে। অতিথিপরায়ণতা গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন সামাজিক কাজ ও উৎসবে সবাই মিলেমিশে অংশ নেয়।

 

৮. ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান: গ্রামের মানুষের জীবনধারায় ধর্মের গভীর প্রভাব রয়েছে। মসজিদ, মন্দির, পূজা-পার্বণ, ঈদ, পূর্ণিমা ও ধর্মীয় মেলা এই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ও নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে তোলে।

 

উপসংহার: বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। এটি আমাদের জাতিসত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও গ্রামীণ সংস্কৃতির শেকড় আজও শক্তিশালী।ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্রামের গৌরবময় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে আমাদের এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং এর প্রচার প্রসার বৃদ্ধি করা উচিত। 

 

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD