সমাজকর্ম কি? সমাজকর্মের ধারণা ও পরিধি
ভূমিকা: সমাজকর্ম হলো এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত সেবামূলক কাজ, যার মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তি, দল, ও সমষ্টির সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করা এবং সমস্যার একটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর সমাধান প্রদান করা। আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়, যা মোকাবিলা করতে বৈজ্ঞানিক ও তাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রয়োজন হয়। সমাজকর্ম সেই জ্ঞান ও তত্ত্ব প্রয়োগ করে, সমস্যা সমাধানের জন্য পদ্ধতিগত সাহায্য প্রদান করে। সমাজকর্মের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যেমন ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম, সমষ্টি সংগঠন, উন্নয়ন, ইত্যাদি, যা মানুষের সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়।
সমাজকর্ম কী?
সমাজকর্ম হলো এমন একটি পেশাগত কাজ, যা ব্যক্তি, দল, এবং সমষ্টিকে সাহায্য করে যাতে তারা নিজেদের সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য অর্জন করতে পারে। সমাজকর্মীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং তারা মানুষের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বৈজ্ঞানিক ও পদ্ধতিগত সহায়তা প্রদান করেন। এর ফলে মানুষ তাদের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হতে পারে এবং নিজেরা নিজেদের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়।
সমাজকর্মের সংজ্ঞা: বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজকর্মের সংজ্ঞা দিয়েছেন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা হলো:
জাতিসংঘ (UNO): সমাজকর্ম হল এমন এক ধরনের কার্যক্রম যা ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করে।
আরো পড়ুনঃ সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন ও ন্যায়তত্ত্ব
হার্বাট বিষ্ণু: সমাজকর্ম এমন একটি পদ্ধতি যা মানুষকে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে, যাতে তারা সমাজের পূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারে।
ডব্লিউ এ ফিডল্যান্ডার: সমাজকর্ম হলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতা নির্ভর পেশা যা ব্যক্তি, দল, বা সমষ্টিকে আত্মসন্তুষ্টি ও স্বনির্ভরতা অর্জনে সাহায্য করে।
সমাজকর্মের পরিধি ও ক্ষেত্রসমূহ: সমাজকর্মের পরিধি অনেক ব্যাপক এবং এটি বিভিন্ন ক্ষেত্র ও সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করা হয়। ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে শুরু করে সামাজিক সমস্যা পর্যন্ত সমাজকর্মের প্রয়োগ রয়েছে। নিচে সমাজকর্মের বিভিন্ন পরিধি ও প্রয়োগ ক্ষেত্র আলোচনা করা হলো:
১। ব্যক্তি সমাজকর্ম: সমাজকর্মের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হলো ব্যক্তি। ব্যক্তি সমাজকর্মে ব্যক্তি পর্যায়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয় এবং সেই অনুযায়ী সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এটি ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজকর্মীরা ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন, তার সমস্যার ধরন বুঝে সমাধানের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেন।
২। দল সমাজকর্ম: সমাজকর্ম এমন একটি পেশা, যা দলীয় সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। দলবদ্ধ কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান, দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা, এবং সমন্বয় সাধনে সমাজকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সমাজের বৃহত্তর সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়।
৩। সমষ্টিগত উন্নয়ন ও সংগঠন: সমষ্টি তথা বৃহৎ সমাজের উন্নয়ন ও সংগঠনের ক্ষেত্রে সমাজকর্মীরা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। একটি সমষ্টির মধ্যে সমস্যা চিহ্নিত করা, সমস্যার কারণ বিশ্লেষণ করা এবং সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমাজকর্মের মাধ্যমে সম্ভব হয়। সমাজকর্মীরা সমাজের উন্নয়নে কাজ করেন এবং জনগণকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন।
৪। শিক্ষাক্ষেত্রে সমাজকর্ম: শিক্ষা ক্ষেত্রে সমাজকর্মের ভূমিকা দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। স্কুল ও কলেজে শিশু ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সমাজকর্মীরা কাজ করেন। শিক্ষার্থীদের সঠিক মানসিক বিকাশ ও শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি হলে, তা দূর করার জন্য সমাজকর্মীরা সহায়তা করে।
৫। পারিবারিক সমাজকর্ম: সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো পরিবার। পারিবারিক সমস্যার সমাধান, বিশেষ করে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বিবাদ, বা কলহ সমাধানে সমাজকর্মীরা কাজ করেন। পারিবারিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হয়।
৬। চিকিৎসাক্ষেত্রে সমাজকর্ম: চিকিৎসাক্ষেত্রে সমাজকর্মীদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিশেষ করে মানসিক রোগীর সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রোগীদের মানসিক অবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান, এবং সামাজিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সমাজকর্মীরা সহযোগিতা করে।
আরো পড়ুনঃ সংবিধান কি? উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
৭। দারিদ্রতা দূরীকরণ: সমাজের দারিদ্রতা দূর করতে সমাজকর্মীরা নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দারিদ্রতা হলো সামাজিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। সমাজকর্মীরা দারিদ্রতা মোকাবিলায় কাজ করেন এবং দারিদ্র বিমোচনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যাতে সমাজের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠতে পারে।
৮। বেকারত্ব দূরীকরণ: যুব সমাজকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে সমাজকর্মীরা কাজ করে। যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বেকারত্ব দূরীকরণে কাজ করা সমাজকর্মের একটি বড় অংশ।
৯। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পুনর্বাসন: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সমাজকর্মীরা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করা, পুনর্বাসন কাজ পরিচালনা করা, এবং মানসিক সহায়তা প্রদান করা সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১০। মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার: সমাজকর্মীরা মানবাধিকার রক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তারা নির্যাতিত, বঞ্চিত, এবং অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
উপসংহার: সমাজকর্ম হলো একটি বৈজ্ঞানিক, পেশাগত এবং সেবামূলক প্রক্রিয়া যা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটি মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মানসিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বর্তমান বিশ্বে সমাজকর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা সমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।