শিল্প বিপ্লব কাকে বলে?

শিল্প বিপ্লব কাকে বলে?

ভূমিকা: শিল্প বিপ্লব ছিল মানব ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন যা আঠারো শতকের শেষ দিকে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপ, বিশেষত ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছিল। এটি মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে যান্ত্রিক উৎপাদনের মাধ্যমে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটায়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যন্ত্রের ব্যবহার, বড় আকারের কারখানার বিকাশ, নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, এবং নগরায়ণ শিল্প বিপ্লবের মূল বৈশিষ্ট্য। এর ফলে মানব সমাজে ব্যাপক অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসে।

শিল্প বিপ্লবের সংজ্ঞা:

শিল্প বিপ্লব বলতে এমন একটি পরিবর্তনকে বোঝায় যা উৎপাদন ব্যবস্থায় যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে ঘটে। প্রথাগত হস্তশিল্প বা ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের পরিবর্তে কারখানা ভিত্তিক বৃহৎ উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক শক্তি, পেশি ও প্রাণীশক্তির পরিবর্তে বাষ্প ও যন্ত্রশক্তিকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়।

আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম গবেষণা কাকে বলে?

সমাজকল্যাণ অভিধান অনুসারে, “শিল্প বিপ্লব এমন একটি পরিবর্তন যা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বৈজ্ঞানিক ও যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে।”

প্রফেসর লেডি উইলিয়াস বলেন, “শিল্প বিপ্লব হলো আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি এবং তার প্রয়োগ পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নাম।”

শিল্প বিপ্লবের উৎপত্তি:

‘শিল্প বিপ্লব’ শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘Indus tria’ থেকে, যার অর্থ দক্ষতা বা শ্রম। বিপ্লব বা ‘Revolution’ বলতে কোনো প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকে বোঝায়। শিল্প বিপ্লব বলতে তাই উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনকে বুঝায়, যেখানে হস্তশিল্প বা ম্যানুয়াল শ্রমের পরিবর্তে যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই বিপ্লব মূলত ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছিল, তবে তা পরবর্তীতে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।

শিল্প বিপ্লবের কারণ:

শিল্প বিপ্লবের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। কিছু প্রধান কারণ নিম্নরূপ:

১. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন শিল্প বিপ্লবের মূলে ছিল। বিশেষত বাষ্প ইঞ্জিন, পাওয়ার লুম, কটন জিন ইত্যাদির আবিষ্কার শিল্পায়নে বিশাল ভূমিকা রাখে।

২. বাজার ব্যবস্থার বিকাশ: শিল্প বিপ্লবের আগেই ইউরোপে একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যা শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাজারের চাহিদা তৈরি করে।

৩. প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য: ইংল্যান্ডে প্রচুর কয়লা, লোহা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল, যা শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিল।

আরো পড়ুনঃ সমাজসেবা কাকে বলে? সমাজসেবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য: শিল্প বিপ্লবের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

১. যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা: হস্তশিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয়। বিশেষত বস্ত্রশিল্প, লোহার কাজ এবং অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ে।

২. কারখানাভিত্তিক উৎপাদন: শিল্প বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কারখানাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা। বড় বড় কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে শ্রমিকরা একসঙ্গে কাজ করত।

৩. শহরায়ন: শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্যাপক হারে শহরায়ন ঘটে। গ্রাম থেকে শহরে লোকজন কাজের সন্ধানে আসতে শুরু করে, যা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং নগরজীবনকে আরও গতিশীল করে।

শিল্প বিপ্লবের প্রভাব:

শিল্প বিপ্লবের প্রভাব ছিল বহুমুখী। এটি কেবল অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

১. অর্থনৈতিক প্রভাব:

শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং পণ্য উৎপাদনের খরচ কমে যায়। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয় এবং নতুন বাজার গড়ে ওঠে।

২. সামাজিক প্রভাব:

শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন নতুন সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়। শ্রমিকরা অত্যন্ত খারাপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়, যা পরবর্তীতে শ্রমিক আন্দোলনের সৃষ্টি করে।

৩. সাংস্কৃতিক প্রভাব:

শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কারখানা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে শ্রমিকরা নতুন পরিবেশে কাজ শুরু করে, যা তাদের চিন্তা-চেতনা এবং সামাজিক সম্পর্কেও পরিবর্তন আনে।

৪. রাজনৈতিক প্রভাব:

শিল্প বিপ্লবের ফলে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটে, যা রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ভারসাম্য পরিবর্তন করে। পুঁজিপতিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে শুরু করে এবং নতুন নতুন অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তিত হয়।

৫. জীবনমানের উন্নয়ন:

শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের জীবনমান উন্নত হয়। কারখানার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা নিয়মিত আয়ের সুযোগ পায় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

আরো পড়ুনঃ দারিদ্রের দুষ্টুচক্র কাকে বলে

উপসংহার: শিল্প বিপ্লব মানবজীবনে এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এনেছে। উৎপাদন ব্যবস্থা, জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে এই বিপ্লব ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যদিও এটি সমাজে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে, তবুও এর ইতিবাচক প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। শিল্প বিপ্লবের ফলাফল আজকের আধুনিক বিশ্বে প্রতিফলিত হয়, যেখানে প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252