বাংলাদেশের সামাজিক অসমতা বৃদ্ধির কারণগুলো উল্লেখ কর।

Shihabur Rahman
বাংলাদেশের
সামাজিক অসমতা বৃদ্ধির কারণগুলো উল্লেখ কর।
অথবা,
সামাজিক অসমতা বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশের সামাজিক অসমতার কারণসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা:
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে
সামাজিক বৈষম্য বা অসমতা একটি বাস্তবতা। সমাজে একাধিক শ্রেণির মধ্যে সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা
ও ক্ষমতার অসম বণ্টন বিভিন্ন ধরণের সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য,
শিক্ষাগত পার্থক্য, লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন, পেশাগত ও গ্রামীণ-শহুরে বিভাজনসহ নানা কারণে
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় অসমতা বিদ্যমান। এই অসমতা জনগণের জীবনযাত্রার মানে বৈষম্য
তৈরি করে এবং সমাজের প্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আভিধানিক অর্থ: ইংরেজি Social Inequality এর বাংলা প্রতিশব্দ সামাজিক অসমতা। Inequality শব্দটি Equality শব্দটির
বিপরীত। যার অর্থ হচ্ছে ‘সমান হওয়া’ (State of seing equal)। তাহলে Inequality শব্দের
অর্থ হচ্ছে অসমান হওয়া। আবার আকৃতি ও মাত্রা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমতার অভাবই হচ্ছে
‘অসমতা’।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী
বিভিন্নভাবে সামাজিক অসমতার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের সংজ্ঞা
প্রদান করা হলো : অক্সফোর্ড অ্যাডভ্যান্সড ডিকশনারি (Oxford Advanced Learner’s
Dictionary)-এর মতে, “সামাজিক অসমতা বলতে বোঝায় এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সমাজের সদস্যবৃন্দ
অসম পরিমাণ বা মাত্রায় সম্পদ, যশ, খ্যাতি ও ক্ষমতার অধিকারী”।
‘Encyclopedia of Sociology’ গ্রন্থে অসমতার
সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Elmer (1981) বলেছেন, “সামাজিক অসমতা বলতে
বুঝায় এমন একটি অবস্থা যেখানে সমাজের সদস্যবৃন্দ অসম পরিমাণ বা মাত্রায় সম্পদ, খ্যাতি
বা ক্ষমতার অধিকারী হয়।”
“সামাজিক
অসমতা উইলিয়াম পি. স্কট (Willam P. Scott) তাঁর ‘Dictionary of Sociology’ গ্রন্থে
বলেন, বলতে গোষ্ঠী বা সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের কারণে অসম সুযোগ সুবিধা
এবং অসম পুরস্কারের অস্তি ত্বকে বুঝায়।”
রবার্টসন
(Robertson) বলেছেন, “Social Inequality exists when some people have greater
share of power, wealth on prestige than others.” অর্থাৎ, যখন সমাজের কতিপয় লোক অন্যান্যদের
তুলনায় বেশি ক্ষমতা, সম্পদ অথবা খ্যাতির অধিকারী হয় তখন সেখানে সামাজিক অসমতা বিরাজ
করছে বলা চলে।
Smelser বলেন, সামাজিক অসমতা বলতে এমন
একটি অবস্থাকে বুঝায় যখন সমাজের পুরস্কারগুলোতে সবার সমান অধিকার বর্তায় না। সমাজের
যা কিছু দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান বলে বিবেচিত হয় সেগুলোকেই বলা হয় পুরস্কার-আর এ
সবেই থাকে অসম অধিকার।
সামাজিক
বৈষম্য বা অসমতা প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মাদ হাবিবুর
রহমান তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি’ বইয়ে (৪র্থ সংস্করণ, পৃঃ ৩৬৫) বলেছেন, “সামাজিক অসমতার অর্থ হচ্ছে মর্যাদা, ক্ষমতা, সম্পদ
ইত্যাদির অসম বণ্টন।” পরিশেষে বলা যায় যে, সম্পত্তি, ক্ষমতা, মর্যাদা এবং জীবনের
অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধার প্রেক্ষিতে পারস্পরিক
বাংলাদেশের
সামাজিক অসমতার প্রধান কারণসমূহ নিচে তুলে ধরা হলোঃ
১.
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য: বাংলাদেশের সামাজিক অসমতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক
বৈষম্য। দেশের সম্পদ ও আয়ের বণ্টন একেবারে সুষম নয়। শহরের বিত্তবান শ্রেণি অধিক সুযোগ-সুবিধা
ভোগ করে, অন্যদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।
আয় বৈষম্যের ফলে সমাজে শ্রেণিগত বিভাজন সৃষ্টি হয়, যা সামগ্রিক সামাজিক অসমতা বৃদ্ধি
করে।
২.
শিক্ষার অসমতা: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা
এখনো পুরোপুরি সমতাভিত্তিক নয়। সরকারি, বেসরকারি, মাদ্রাসা এবং ইংরেজি মাধ্যমের মধ্যে
বিশাল পার্থক্য রয়েছে। বিত্তশালী শ্রেণি উন্নতমানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়, অন্যদিকে
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা নিম্নমানের শিক্ষার সুযোগ পায়। এই বৈষম্যের ফলে ধনী-গরিবের
মধ্যে জীবনমানের বিশাল পার্থক্য তৈরি হয়।
৩.
লিঙ্গ বৈষম্য: নারী ও পুরুষের
মধ্যে বৈষম্য বাংলাদেশের অন্যতম বড় সামাজিক সমস্যা। নারীদের এখনো শিক্ষা, কর্মসংস্থান
ও সম্পত্তির অধিকারে পিছিয়ে রাখা হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের
সুযোগ কম এবং তাদের পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবমূল্যায়ন করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন
না হওয়ায় সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী পিছিয়ে রয়েছে, যা সামগ্রিক সামাজিক অসমতাকে আরও তীব্র
করে তুলছে।
৪.
গ্রামীণ ও শহুরে বৈষম্য: বাংলাদেশে
শহর ও গ্রামবাসীর জীবনযাত্রার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। শহরাঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,
যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জীবিকার সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি, অন্যদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী
মৌলিক চাহিদা পূরণে পিছিয়ে। এই কারণে শহরের মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে, কিন্তু গ্রামের
মানুষ পিছিয়ে থাকছে, যা সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
৫.
বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশে
শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামীণ
অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় বহু মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হয়। কর্মসংস্থানের
অভাব শুধু ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে না, বরং এটি সামাজিক অবস্থানের মধ্যেও
এক ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি করে।
৬.
ভূমি ও সম্পদের বৈষম্য: বাংলাদেশের
সামাজিক অসমতার অন্যতম কারণ হলো ভূমি ও সম্পদের অসম বণ্টন। ধনী ব্যক্তি ও শিল্পপতিরা
বিশাল পরিমাণ জমি ও সম্পদের মালিক, অন্যদিকে দরিদ্র কৃষকরা ভূমিহীন অবস্থায় মানবেতর
জীবনযাপন করে। ভূমি সংক্রান্ত আইন ও ভূমিহীনদের জন্য কার্যকর নীতি না থাকায় এই বৈষম্য
দিন দিন বেড়েই চলেছে।
৭.
স্বাস্থ্যসেবার অসমতা: দেশে
সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। শহরাঞ্চলে উন্নতমানের
চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও গ্রামে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা নাজুক। দরিদ্র জনগণ পর্যাপ্ত চিকিৎসা
সুবিধা পায় না, যা তাদের জীবনমানের অবনতি ঘটায়।
৮.
সামাজিক ও পারিবারিক শ্রেণিবিভাগ: বাংলাদেশের
সমাজে সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক পার্থক্য প্রকট। ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে
জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উচ্চবিত্তরা সব সুবিধা
ভোগ করে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা বঞ্চিত হয়।
৯.
রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: রাজনৈতিক ক্ষমতা সাধারণ জনগণের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টিত নয়। ক্ষমতাসীন
গোষ্ঠী ও তাদের অনুসারীরা অধিক সুবিধা ভোগ করে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণ প্রভাবশালী রাজনৈতিক
নেতাদের ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকে। ফলে সমাজে প্রভাবশালী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে
ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়।
১০.
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: বাংলাদেশে
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সামাজিক বৈষম্যের অন্যতম প্রধান কারণ। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে
দুর্নীতি বিদ্যমান থাকায় দরিদ্র ও সাধারণ জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
১১.
ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য: বাংলাদেশে
কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। তাদের
আর্থসামাজিক উন্নয়নে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় তারা পিছিয়ে পড়ছে।
১২.
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বৈষম্য: দেশের
কিছু অঞ্চল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে, অন্যদিকে অনেক অঞ্চল এখনো ডিজিটাল
সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে যারা প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছে, তারা এগিয়ে যাচ্ছে, আর যারা
পাচ্ছে না, তারা পিছিয়ে থাকছে।
১৩.
শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব: শিক্ষার
অভাবের কারণে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। ফলে
তারা বৈষম্যের শিকার হয়েও প্রতিবাদ করতে পারে না।
১৪.
বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা: অনেক
ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ধনী ও ক্ষমতাশালীরা নিজেদের সুবিধামতো
আইন প্রয়োগ করতে পারে, কিন্তু গরিবরা আইনি সহায়তা পেতে হিমশিম খায়।
১৫.
পরিবেশগত বৈষম্য: প্রাকৃতিক দুর্যোগ
ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের কিছু অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে সেখানকার জনগণের
জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে।
১৬.
সংস্কৃতি ও কুসংস্কারের প্রভাব: কিছু
সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামি নারীদের অবদমন, দরিদ্রদের প্রতি অবিচার এবং সামাজিক বৈষম্য
বৃদ্ধি করে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের সামাজিক অসমতা একটি বাস্তবতা,
যা বহু কারণে সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনো বজায় রয়েছে। এই বৈষম্য কমাতে হলে সমান শিক্ষা,
অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন, নারীর ক্ষমতায়ন, বিচারব্যবস্থার
সংস্কার এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি এনজিও,
সুশীল সমাজ ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সামাজিক অসমতা হ্রাস করা সম্ভব, যা
একটি উন্নত, সুষম ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।
3
সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বলতে কি বুঝ?

Shihabur Rahman
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি?

Shihabur Rahman
মরণশীলতা ও প্রজননশীলতা বলতে কি বুঝ?

Shihabur Rahman
উপনিবেশবাদ কি?

Shihabur Rahman
গ্রামীণ সমাজের / সম্প্রদায়ের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা কর।
