রাষ্ট্রবিজ্ঞান কী? রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? সংক্ষেপে আলোচনা কর।
ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political Science) হলো এমন একটি শাস্ত্র যেখানে রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো অধ্যয়ন করা হয়। এটি একটি সমাজবিজ্ঞান শাখা যা রাষ্ট্রের গঠন, কার্যক্রম এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের কাঠামো, সরকারের নীতি, জনমত, ক্ষমতার ব্যবহার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে। এটি রাষ্ট্রের গতিশীলতা এবং পরিচালনার পদ্ধতি নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা:
অধ্যাপক গিলক্রিস্ট বলেছেন, “Political Science deals with the State and Government,” অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে।
অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে।”
অধ্যাপক বার্জেস বলেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিজ্ঞান।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞান মূলত রাষ্ট্র ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাঠামো, নীতি এবং পরিচালনা প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে।
আরো পড়ুনঃ সংবিধান কি? উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতি:
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে যা রাষ্ট্রের প্রকৃতি, শাসন ব্যবস্থা এবং এর ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান প্রদান করে। নিচে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের প্রধান পদ্ধতিগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical Method): এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, বিকাশ, এবং ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা হয়। অতীতের ঘটনাবলী এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভিত্তি করে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার উপসংহার টানা হয়। পলক বলেছেন, “ঐতিহাসিক পদ্ধতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে বিকশিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করে।”
২. পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি (Observational Method): এ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। পর্যবেক্ষণ দ্বারা বিভিন্ন দেশ এবং তাদের শাসনব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ধারণ করা হয়, যা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব তৈরি হয়। লর্ড ব্রাইস এবং লোয়েল এই পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছেন।
৩. পরীক্ষামূলক পদ্ধতি (Experimental Method): এই পদ্ধতিতে নতুন আইন, নীতি এবং শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দেশে শাসন ব্যবস্থার কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো সুপারিশ করেন। তবে রাষ্ট্রের পরিবর্তনশীল প্রকৃতির কারণে এই পদ্ধতি সীমিত হতে পারে।
৪. দার্শনিক পদ্ধতি (Philosophical Method): দার্শনিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের প্রয়োজন, প্রকৃতি এবং আদর্শ সম্পর্কে অনুমানের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো, এবং হেগেলের মতো দার্শনিকরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এটি সাধারণত রাষ্ট্রের আদর্শ নৈতিক অবস্থান সম্পর্কে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রদান করে।
আরো পড়ুনঃ সার্বভৌমত্ব ও সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণা
৫. তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative Method): এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়। এরিস্টটল ১৫৮টি নগররাষ্ট্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক তত্ত্বগুলো তৈরি করেছিলেন। তুলনামূলক পদ্ধতি বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্নতি এবং ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
৬. আইনমূলক পদ্ধতি (Judicial Method): এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রকে আইনপ্রণয়ন এবং আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাষ্ট্রের আইন এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়। গেটেল বলেছেন, “আইনমূলক পদ্ধতি রাষ্ট্রকে আইনের একটি সত্তা হিসেবে গণ্য করে।”
৭. জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি (Biological Method): জীববিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রেরও একটি অঙ্গসংস্থান ও কার্যবিধি রয়েছে। রাষ্ট্রের গঠন এবং কার্যকারিতা জীববিজ্ঞানের সাদৃশ্যমূলক ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। তবে এই পদ্ধতি কিছু সময়ে বিভ্রান্তিকর হতে পারে, কারণ রাষ্ট্র ও জীববিজ্ঞানগত সাদৃশ্য পুরোপুরি এক নয়।
৮. মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি (Psychological Method): এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের স্বরূপ ও এর কার্যক্রম বোঝার জন্য মানুষের মানসিক প্রবণতা এবং মনোবিজ্ঞান নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। রাজনৈতিক দল, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং জনমত গঠনের জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।
৯. অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি (Empirical Method): আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি প্রয়োগের প্রবণতা বেশি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আচরণবাদী তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যাবলি বিশ্লেষণ করেন। তথ্য সংগ্রহ, পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১০. সাক্ষাৎকার পদ্ধতি (Interview Method): এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সরাসরি জনসাধারণের সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আমলাতন্ত্র, এবং সাধারণ মানুষের মতামত জানতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এটি সরাসরি তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি কার্যকরী পদ্ধতি।
১১. পরিসংখ্যান পদ্ধতি (Statistical Method): সংখ্যাত্মক তথ্য ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যাবলির বিশ্লেষণ করা হয়। রাষ্ট্রের নীতি, জনমত, এবং নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
১২. প্রতিষ্ঠানগত পদ্ধতি (Institutional Method): এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং আইনসভা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ও গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়। এটি রাষ্ট্রের কাঠামো এবং এর কার্যকারিতা নির্ধারণে সাহায্য করে।
উপসংহার: রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে প্রতিটি পদ্ধতিই রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও কাঠামো সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জটিল প্রকৃতি ও পরিবর্তনশীল উপাদানসমূহের জন্য একটি একক পদ্ধতি যথেষ্ট নয়। তাই বিভিন্ন পদ্ধতির সমন্বয় করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা হয়।