রাষ্ট্র কী? আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি আলোচনা কর।
ভূমিকা: রাষ্ট্র হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য কাজ করে। প্রাচীন দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটল রাষ্ট্রকে একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছিলেন, যা সমাজের শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার এবং মানুষের উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের কার্যাবলির পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র কেবলমাত্র শাসনকাজে নিয়োজিত থাকে না, বরং জনকল্যাণমূলক কাজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা: রাষ্ট্রের প্রামাণ্য সংজ্ঞা হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস বলেন, “একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টিই হল রাষ্ট্র।” অধ্যাপক গার্নার বলেছেন, “রাষ্ট্র হল সাধারণভাবে বৃহৎ এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যার একটি সুসংগঠিত সরকার রয়েছে।”
আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি: আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলি দুইভাবে বিভক্ত করা যায়—অপরিহার্য কার্যাবলি এবং ঐচ্ছিক কার্যাবলি। আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা, এবং এই কার্যাবলির মাধ্যমেই রাষ্ট্র জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধন করে থাকে।
আরো পড়ুনঃ রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা | আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর ভূমিকা
ক. অপরিহার্য কার্যাবলি (Essential functions):
অপরিহার্য কার্যাবলি হলো সেসব কার্যাবলি যা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। যদি এই কার্যাবলিগুলো রাষ্ট্র সম্পন্ন না করে, তাহলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। নিচে এসব কার্যাবলি আলোচনা করা হলো—
১. প্রশাসন পরিচালনা: রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শাসনকার্য পরিচালনা করা। এজন্য রাষ্ট্রকে আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ, এবং প্রশাসনিক কার্যাবলি সম্পন্ন করতে হয়। প্রশাসন পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রকে সঠিক নীতিমালা এবং কর্মচারীদের সঠিকভাবে নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দিতে হয়।
২. অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা: রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এজন্য রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনী, বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. সার্বভৌমত্ব রক্ষা: রাষ্ট্রকে তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে সামরিক বাহিনী গঠন এবং বাহ্যিক শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। সার্বভৌমত্ব হারালে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
৪. অর্থনৈতিক কার্যাবলি: রাষ্ট্রের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন ধরনের কর আদায়, বাজেট প্রণয়ন, এবং অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরি করা রাষ্ট্রের অন্যতম অপরিহার্য কাজ।
৫. বিচারকার্য: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্রকে বিচার বিভাগ গঠন করতে হয়। সুষ্ঠু বিচার এবং নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র অপরাধীদের শাস্তি দেয় এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
৬. আইন প্রণয়ন: রাষ্ট্রকে আইন প্রণয়ন করতে হয় এবং তা প্রয়োগ করতে হয়। আইন সভা গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করে এবং আইনগুলো যাতে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় তার দায়িত্ব পালন করে।
৭. কূটনৈতিক সম্পর্ক: আধুনিক রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাধ্যমে রাষ্ট্র বাণিজ্য, কূটনৈতিক সমঝোতা এবং অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করে।
৮. নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: রাষ্ট্র নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দায়বদ্ধ। নাগরিকদের জানমালের সুরক্ষা বিধান রাষ্ট্রের অপরিহার্য কার্যাবলির মধ্যে একটি।
৯. অধিকার রক্ষা: আধুনিক রাষ্ট্রের আরেকটি অপরিহার্য কাজ হলো নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকে এবং সেই অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করে।
খ. ঐচ্ছিক কার্যাবলি (Optional functions):
রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কার্যাবলি সেইসব কার্যাবলি যা রাষ্ট্র বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করতে হয় না, কিন্তু জনকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে। এসব কার্যাবলি সমাজের সার্বিক উন্নতি এবং নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ।
১. শিক্ষা কার্যাবলি: শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড। আধুনিক রাষ্ট্র শিক্ষাবিস্তারের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করে রাষ্ট্র জনগণকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করে।
২. জনস্বাস্থ্য কার্যাবলি: আধুনিক রাষ্ট্র নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মাতৃসদন, এবং অন্যান্য জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান গঠন করে। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন রাষ্ট্রের অন্যতম গৌণ কাজ।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন: রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য একটি সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। রাষ্ট্র রাস্তাঘাট নির্মাণ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে।
৪. সামাজিক নিরাপত্তা: আধুনিক রাষ্ট্র সমাজের অসহায় এবং দরিদ্র জনগণকে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যাবলি সম্পন্ন করে। যেমন বয়স্ক ভাতা, বেকার ভাতা, এবং সামাজিক পুনর্বাসন।
৫. শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়ন: আধুনিক রাষ্ট্র শিল্প ও বাণিজ্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গঠন, ব্যাংক এবং বীমা সংস্থার উন্নয়ন রাষ্ট্রের গৌণ কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।
৬. শ্রমিক কল্যাণ: আধুনিক রাষ্ট্র শ্রমিকদের জন্য বেতন, কাজের সময়, এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নিশ্চিত করে। শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্র শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করে।
আরো পড়ুনঃ জাতি ও জাতীয়তাবাদ কাকে বলে?
৭. কৃষি উন্নয়ন: কৃষক এবং কৃষির উন্নয়নে আধুনিক রাষ্ট্র ঋণ সুবিধা, কৃষি প্রযুক্তি, সার, এবং কীটনাশকের মতো উপকরণ সরবরাহ করে। কৃষির উন্নয়ন রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।
উপসংহার: আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলির পরিধি বেশ বিস্তৃত। একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অপরিহার্য কার্যাবলির পাশাপাশি ঐচ্ছিক কার্যাবলিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক রাষ্ট্র কেবল শাসনকাজে নিযুক্ত থাকে না, বরং সমাজের সার্বিক কল্যাণ এবং জনগণের উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সমাজের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হয় এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নের দায়িত্বও রাষ্ট্রকে পালন করতে হয়।