বাংলাদেশের বিবাহ ও পরিবারের সাম্প্রতিক প্রবণতা আলোচনা কর।

Avatar

Shihabur Rahman

Academic

বাংলাদেশের বিবাহ ও পরিবারের সাম্প্রতিক প্রবণতা আলোচনা কর।

 অথবা, পরিবার ও বিবাহের  সাম্প্রতিক প্রবণতা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, সমকালীন বাংলাদেশে বিবাহ ও পরিবারের পরিবর্তনশীল রূপ আলোচনা কর।

ভূমিকা: পরিবার এবং বিবাহ মানব জীবনের মূল এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম। সংস্কৃতি ও সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক জীবনধারা, নগরায়ণ, শিক্ষার প্রসার এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে বিবাহ এবং পরিবারের কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা যেমন শিল্পবিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতি, পাশাপাশি বিশ্বায়ন—এই সবই বিবাহ ও পরিবারের কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

 

পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা: পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজ পরিবার এবং বিবাহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবার এবং বিবাহ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে পরিবার ও বিবাহের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিচে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো;

 

১। বিবাহ পদ্ধতিতে পরিবর্তন: সাধারণত অভিভাবকগণ বিবাহের আয়োজন করে থাকেন। তবে বর্তমান সময়ে একক বিবাহ বা প্রেমবিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্র দেখা যায়, বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র পাত্রীর পরিবারের সঙ্গে মতের মিল না হলে তারা নিজেরাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। শহরাঞ্চলে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে বিবাহের প্রবণতা বেশি।

 

২। বিবাহনীতির পরিবর্তন: আগের তুলনায় এখন বিবাহের আনুষ্ঠানিকতায় বা নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। আগে বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী দেখা থেকে শুরু করে সবকিছুতে অভিভাবকদের আধিক্য পরিলক্ষিত হলেও বর্তমানে পাত্র পাত্রীর  মতামতের উপর অধিকাংশ বিবাহ সংঘটিত হয়। আগের দিনের সাদামাটা বিবাহের অনুষ্ঠানের পরিবর্তে এখন বিয়ের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, আবার  কিছু বিবাহ বিশাল আয়োজনে সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা অনেকটাই সীমিত হয়ে এসেছে।

 

৩। বিবাহের বয়স বৃদ্ধি: পূর্বের তুলনায় বর্তমানের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের মাঝে অধিক পরিণত বয়সে বিবাহ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় পূর্বে আমাদের সমাজে বাল্যবিবাহ বা অল্প বয়সে বিবাহ প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে ছেলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ,ক্যারিয়ার গঠন,ইত্যাদির কারণে বিবাহের গড় বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

৪। বহুবিবাহ ও বহুগামিতার হ্রাস: পূর্বের সমাজে সম্পদশালী পুরুষের মাঝে বহু বিবাহের প্রবণতা থাকলেও বর্তমানে তা কমেছে। এখন একক বিবাহের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশাপাশি একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রবণতাও কমে আসছে। 

 

৫। অর্থনৈতিক কারণে বিবাহ বিলম্বিত হচ্ছে: বর্তমান সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে বিলম্ব একটি দৃশ্যমান বিষয়। শিক্ষিত নারী-পুরুষ,অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, ক্যারিয়ার গঠন, জীবনে স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা  কারণে দেরিতে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।

 

৬। যৌতুক প্রথার প্রসার: যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ। যুবসমাজ কিছুতেই এ অভিশাপ থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। পূর্বের তুলনায় এটি কিছুটা কমলেও তা যথেষ্ট নয়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে যৌতুকের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত সমাজে যৌতুক বিরোধী মনোভাব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

 

পরিবারের সাম্প্রতিক প্রবণতাঃ পরিবার হলো ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠন। সমাজের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবার কাঠামোতে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। যেমন:

 

১। পরিবারের আকারে পরিবর্তন: পূর্বে বাংলাদেশের পরিবারগুলো ছিল মূলত যৌথ পরিবার যেখানে মা-বাবা ভাই-বোন সকলে মিলে একত্রে বসবাস করত। কিন্তু বর্তমানে যৌথ পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর গ্রাম উভয় স্থানে একক পরিবারের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

২। অর্থনৈতিক কারণে পরিবর্তন: আধুনিক জীবন ব্যবস্থা, যোগাযোগের সুযোগ সুবিধা এবং আত্মকর্মসংস্থানের কর্মসংস্থানের কারণে অনেক মানুষ গ্রাম থেকে শহরে চলে যাচ্ছে ফলে পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

৩। নারীর কর্মজীবন বৃদ্ধি: বর্তমান সময়ে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবারে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অর্থনৈতিকভাবে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। এতে করে পরিবার কাঠামোতে সমতার সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে।

 

৪। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন: আগেকার দিনে শিশুদের পারিবারিকভাবে লালন-পালন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে বেবি কেয়ার, নার্সারি, ডে-কেয়ার, স্কুল ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুদের লালন-পালনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

৫। জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন: আধুনিক সমাজে দাম্পত্য সম্পর্ক ও পারিবারিক বন্ধনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে দাম্পত্য জীবনের প্রতি মানুষ বাস্তববাদী হয়ে উঠেছে।

 

৬। কর্তৃত্বের পরিবর্তন: পূর্বে যৌথ পরিবার গুলোতে পরিবারের সর্বময় কর্তৃত্ব পিতা বা স্বামীর হাতে ব্যস্ত থাকতো।  কিন্তু বর্তমানে বিশেষত শিক্ষিত পরিবারগুলোতে, পরিবারের কর্তৃত্ব বা ক্ষমতায় মা-বাবা উভয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যা পরিবার কাঠামোর সাম্প্রতিক প্রবণতার অন্যতম বিষয়।

 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, মানুষের সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে পরিবার এবং বিবাহের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বর্তমানে আধুনিক জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, প্রযুক্তির প্রসার এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের ফলে বিবাহ ও পরিবারের গতানুগতিক ধারা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার গঠন, দেরিতে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি, নারীর ভূমিকার পরিবর্তন, এবং ডিজিটাল যুগের সংস্পর্শে সম্পর্কের নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে। সুতরাং আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহ ও পরিবারের পরিবর্তনের ধারা একটা চলমান প্রক্রিয়া যা সামগ্রিকভাবে মানব জীবনকে প্রভাবিত করে।

 

Links

Home

Exams

Live Exam

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD