প্লেটোর ন্যায়ধর্ম তত্ত্ব আলোচনা কর। অথবা, প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব আলোচনা কর।
ভূমিকা: প্লেটো ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন মহান দার্শনিক, যিনি আধুনিক ন্যায়বিচারের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করেছেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ “The Republic”-এ ন্যায়বিচার তত্ত্ব বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই তত্ত্বে প্লেটো প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে ন্যায়বিচার শুধুমাত্র একটি সামাজিক প্রথা বা চুক্তি নয়, বরং এটি মানব প্রকৃতির মধ্যে নিহিত এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব জাতির কল্যাণ। প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার শাসকের নৈতিক দায়িত্ব, যা শাসিতের মঙ্গল বিধানে নিবেদিত। মেষপালকের ধর্ম যেমন মেষপালের যত্ন নেওয়া, তেমনি শাসকের ধর্ম হলো তার শাসনাধীন মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা।
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব: প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো ন্যায়বিচার একটি অন্তর্নিহিত নীতি, যা মানব প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত। প্লেটো বিশ্বাস করেন, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যায়বিচারের কোনো পার্থক্য নেই। প্লেটো যখন আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা প্রণয়ন করেন, তখন তিনি ন্যায়বিচারের ধারণাকে রাষ্ট্রের কাঠামোর অভ্যন্তরে অন্তর্ভুক্ত করেন। তার মতে, ন্যায়বিচার একটি বিশেষ গুণ, যা অন্য গুণাবলির বাইরে থেকে আদর্শ রাষ্ট্রে বিরাজ করে। আদর্শ রাষ্ট্রে প্রত্যেক ব্যক্তি যখন তার নিজস্ব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে এবং অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না, তখনই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা: প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার বলতে বোঝায় যে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির সুষ্ঠু দায়িত্ববোধ ও যথাযথ কাজ করা। ব্যক্তি যদি শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যে কাজে সবচেয়ে যোগ্য, সেই কাজেই নিয়োজিত থাকে এবং অন্যের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, তবেই প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরো পড়ুনঃ প্লেটোর দার্শনিক রাজার বৈশিষ্ট্যসমূহ
প্লেটোর ন্যায়বিচারের মূলনীতি: প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তার ন্যায়বিচার ধারণাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। নিচে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. সামাজিক বন্ধন: ন্যায়বিচার হলো সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। এটি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীকে একটি অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ করে। প্লেটোর মতে, একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তুলতে ন্যায়বিচার একটি মৌলিক প্রয়োজনীয়তা, যা সমাজের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
২. যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থান নির্ধারণ: প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাদের প্রকৃতি ও শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে সঠিক স্থানে রাখে। একজন ব্যক্তির শিক্ষাগত ও স্বাভাবিক যোগ্যতা অনুযায়ী তার কর্ম নির্ধারণ করা হলে সেই রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. বিরোধহীন ন্যায়বিচার: প্লেটোর ন্যায়বিচার ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি করে না। তার মতে, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো প্রকৃত বিরোধ থাকলে ন্যায়বিচার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু একটি ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র একে অপরের পরিপূরক।
৪. আধ্যাত্মিক পদ্ধতি: প্লেটোর ন্যায়বিচার কোনো শারীরিক বা বাহ্যিক বিষয় নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া। তার মতে, ন্যায়বিচার ব্যক্তি ও শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি না করে, বরং একে অপরকে সাহায্য করে।
৫. চারিত্রিক বিকাশ: ন্যায়বিচার ব্যক্তির নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়নে সহায়ক। প্লেটোর মতে, ব্যক্তি যখন নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে, তখন তার নৈতিক গুণাবলি ও চারিত্রিক স্থিতি উন্নত হয়। ফলে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ ও সৎ নাগরিকে পরিণত হয়।
৬. সততা: প্লেটোর ন্যায়বিচারের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সততা। তিনি মনে করেন, ন্যায়বিচার মানুষকে সৎ নাগরিকই তৈরি করে না, বরং তাকে সৎ মানুষ হিসেবে পরিণত করে। সততার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা টিকে থাকে।
আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
৭. রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক জীবনের সমন্বয়: প্লেটোর মতে, নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যক্তি যখন ন্যায়বিচারের নীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করে, তখন নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
৮. শিল্পকৌশল: ন্যায়বিচারকে প্লেটো শিল্পকৌশল হিসেবে বিবেচনা করেন। তার মতে, ন্যায়বিচারের অনুশীলন ও উৎকর্ষতা অর্জন করা শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব। যে ব্যক্তি ন্যায়বিচারের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, সে একজন প্রকৃত ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের সমালোচনা:
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব সমকালীন সমাজের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হলেও তার তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে তার ন্যায়বিচার তত্ত্বের সমালোচনা করা হলো:
১. গণতন্ত্র বিরোধী: প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব গণতন্ত্রের বিপরীত। তিনি দার্শনিক রাজাদের হাতে শাসন ক্ষমতা সমর্পণ করে অভিজাততন্ত্রের সমর্থন করেছেন, যা বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২. ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী: প্লেটোর ন্যায়বিচার ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি প্রতিকূল। তিনি রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তির স্বাধীনতাকে ত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রের স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন, যা সমকালীন মানবাধিকারের পরিপন্থী।
৩. নাগরিক অধিকার উপেক্ষা: প্লেটো তার ন্যায়বিচার তত্ত্বে নাগরিক অধিকারকে সঠিকভাবে বিবেচনা করেননি। তিনি সাধারণ জনগণকে উৎপাদক শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তাদের সুনির্দিষ্ট অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন।
৪. নৈতিকতায় অতিরিক্ত গুরুত্ব: প্লেটো নৈতিক মূল্যকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে তার রাষ্ট্রতত্ত্ব অনেকাংশে নীতিশাস্ত্রের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি এবং তা এক ধরনের আদর্শবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন।
আরো পড়ুনঃ স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।
পর্যালোচনা: প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের সমালোচনা করা হলেও এটি তার যুগের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। প্লেটোর সময় গ্রীক সমাজে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে রক্ষা পেতে তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব একটি আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ন্যায়বিচার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। প্লেটো তার ন্যায়বিচার তত্ত্বে নৈতিকতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখিয়েছেন যে, একজন ব্যক্তি বা রাষ্ট্র যখন নৈতিকতার ভিত্তিতে কাজ করে, তখনই প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার: প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব একটি আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য কিরূপ ন্যায়বিচার প্রয়োজন তা ব্যাখ্যা করে। যদিও তার ন্যায়বিচার তত্ত্ব আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তবুও এটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার হলো সামাজিক ঐক্যের মূল চাবিকাঠি, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নাগরিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করে। তাই প্লেটোর ন্যায়বিচারের তত্ত্ব আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য একটি মূল্যবান দার্শনিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।