পেশা বলতে কী বুঝ? পেশার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর

পেশা বলতে কী বুঝ? পেশার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর

ভূমিকা: সমাজকর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা, যা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে জনকল্যাণে কাজ করে। শিল্পায়ন এবং শহরায়নের ফলে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলি মোকাবিলার জন্য আধুনিক সমাজকর্মের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সমাজকর্ম আজ পেশাদার একটি ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর পেশাগত স্বীকৃতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আরও দৃঢ় হয়েছে।

পেশা কী:

‘পেশা’ বলতে এমন একটি কাজকে বোঝায়, যা মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা এবং শিক্ষা প্রয়োগ করে। পেশার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Profession’ ল্যাটিন শব্দ ‘Professor’ থেকে এসেছে, যার অর্থ “to make a public declaration,” অর্থাৎ একটি বিশেষ কাজের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া।

আরো পড়ুনঃ সামাজিক নিরাপত্তা বলতে কি বুঝায়?

পেশার প্রামাণ্য সংজ্ঞা:

  • Dictionary of Social Welfare অনুসারে: “পেশা হলো এমন একটি বৃত্তি, যা বিশেষায়িত শিক্ষা, দক্ষতা ও কৌশল দ্বারা পরিচালিত হয় এবং সাধারণ নীতিমালা ও নৈতিক মানদণ্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।”
  • A. E. Genn তাঁর ‘Dictionary of Management’ গ্রন্থে বলেন: “পেশা হলো এমন একটি সেবা, যার জন্য একজন পেশাজীবীকে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে হয়, যা অন্যদের শিক্ষা দেওয়া, নির্দেশনা দেওয়া বা উপদেশ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।”

পেশার বৈশিষ্ট্যসমূহ:

সমাজবিজ্ঞানী William E. Wickenden এবং অন্যান্যদের মতে, পেশার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

  1. বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা: পেশাদার ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে, যার মাধ্যমে তিনি জনসেবায় নিয়োজিত হবেন।
  2. চারিত্রিক গুণাবলি ও প্রশিক্ষণ: পেশায় প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট গুণাবলি ও প্রশিক্ষণ আবশ্যক।
  3. বিশেষ নীতিমালা: প্রতিটি পেশারই নির্দিষ্ট নৈতিক মানদণ্ড থাকা জরুরি।
  4. প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি: পেশাদারিত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি থাকা আবশ্যক।
  5. পেশাগত সংগঠন: পেশার উন্নয়নের জন্য একটি সংগঠন থাকা প্রয়োজন, যা পেশার নীতিমালা নির্ধারণ ও উন্নয়নে কাজ করবে।

পেশাদার সমাজকর্মের বিবর্তন:

১. প্রাচীন যুগ: প্রাচীনকাল থেকে মানুষ পরস্পরের সহায়ক হিসেবে কাজ করত। ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় জনসেবা যেমন—অনাথাশ্রম, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। এ ধরনের সেবামূলক কার্যক্রম সমাজকল্যাণের প্রাথমিক রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়।

২. মধ্যযুগ: মধ্যযুগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন—গির্জা ও মঠগুলো সমাজকল্যাণমূলক কাজ করত। ধর্মীয় নেতারা জনসেবায় নিয়োজিত ছিলেন এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন।

আরো পড়ুনঃ গ্রামীণ সমাজসেবা কি

৩. আধুনিক যুগ: আধুনিক সমাজকল্যাণের সূচনা ঘটে ১৮শ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের পর। শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে ইংল্যান্ডে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক আইন প্রণীত হয়। ১৬০১ সালের দরিদ্র আইন এবং ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন সমাজকর্মের প্রাথমিক রূপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

৪. যুক্তরাষ্ট্রের অবদান: সমাজকর্মকে পেশাদার রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান অনেক। সেখানে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম গৃহীত হয়, যা সমাজকর্মকে পেশাদার রূপ দিতে সহায়ক হয়।

৫. দান সংগঠন সমিতি (Charity Organization Society – COS): ১৮৭৭ সালে নিউইয়র্কে ‘দান সংগঠন সমিতি’ গঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল দরিদ্রদের কার্যকরভাবে সাহায্য করা। এর ফলে সমাজকর্ম পেশা হিসেবে বিকাশ লাভ করে।

৬. সেটেলমেন্ট হাউস আন্দোলন: ১৮৮৪ সালে লন্ডনে ‘Toynbee Hall’ নামে প্রথম সেটেলমেন্ট হাউস স্থাপিত হয়, যা বস্তিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করত। এ আন্দোলন সমাজকর্ম পেশার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৭. নিউইয়র্ক স্কুল অব ফিলানথ্রপি: ১৮৯৮ সালে নিউইয়র্কে ‘নিউইয়র্ক স্কুল অব ফিলানথ্রপি’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সমাজকর্মীদের পেশাদার প্রশিক্ষণ প্রদান করত। এ প্রতিষ্ঠান সমাজকর্ম পেশার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৮. পত্রিকা প্রকাশ: ১৮৯১ সালে ‘Charities Review’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা সমাজকর্ম পেশার বিকাশে মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে।

৯. আন্তর্জাতিক সম্মেলন: ১৯২৮ সালে প্যারিসে প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজকর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের মাধ্যমে সমাজকর্ম পেশার বিকাশে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

১০. পেশাগত সংগঠন: ১৯৫৫ সালে আমেরিকায় ‘জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি’ (NASW) গঠিত হয়, যা সমাজকর্ম পেশাকে পেশাগত মর্যাদা দেয়।

১১. নৈতিক নীতিমালা: ১৯৫১ সালে সমাজকর্ম পেশার নৈতিক নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়, যা পেশাদার সমাজকর্মীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।

আরো পড়ুনঃ সামাজিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

উপসংহার: সমাজকর্ম আজ একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এর পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে, যা সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক সমাজকর্মের মূল ভিত্তি ইংল্যান্ডে স্থাপিত হলেও, এর পেশাগত বিকাশ যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণতা লাভ করে। সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজকর্ম আজ সারা বিশ্বে পেশাদার রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা সমাজের সেবামূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252