ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ও বিস্তার

Avatar

Shihabur Rahman

Academic

 ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ও বিস্তার

 

ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনামলে Divide and Rule নীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে দেওয়া হয়। ব্রিটিশরা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে তাদের শাসনব্যবস্থাকে সুসংহত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে এ বিভাজন ভারতীয় সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে তোলে। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চূড়ান্ত পরিণতি হয় ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভক্তি, যা এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। 

 

ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারের কারণ ও প্রভাবঃ

 

ব্রিটিশদের ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতিঃ ব্রিটিশরা বুঝতে পারে যে, ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাদের শাসন ব্যাহত হতে পারে। তাই তারা পরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন সৃষ্টি করে। একদিকে তারা মুসলমানদের প্রশাসন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, অন্যদিকে হিন্দুদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। আবার, ১৯০৯ সালের ‘মিন্টো-মার্লে সংস্কার’ ও ১৯১৯ সালের ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার’-এর মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়, যা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি মজবুত করে। 

 

শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতাঃ ব্রিটিশ আমলে শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়। মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী হয়নি, ফলে তারা প্রশাসনিক চাকরিতে পিছিয়ে পড়ে। অপরদিকে, হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষায় অগ্রসর হওয়ায় সরকারি চাকরিতে আধিপত্য বিস্তার করে, যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন আরও বাড়িয়ে তোলে। 

 

রাজনৈতিক দল ও সাম্প্রদায়িকতাঃ ১৯০৬ সালে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলিম লীগ গঠিত হয়, যা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার কথা বললেও বাস্তবে এটি ব্রিটিশদের সাম্প্রদায়িক নীতিকে শক্তিশালী করে। অপরদিকে, কংগ্রেস হিন্দু নেতৃত্বের প্রতি বেশি ঝুঁকে থাকায় মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়তে থাকে। 

 

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও প্রতিযোগিতাঃ ব্রিটিশরা হিন্দুদের হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুযোগ বেশি দেয়, ফলে মুসলমানদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ জন্ম নেয়। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে উসকে দেয় এবং পরবর্তীকালে ভারত বিভক্তির পথ প্রশস্ত করে। 

 

ধর্মীয় বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঃ ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই এই দাঙ্গার মাত্রা বাড়তে থাকে। বিশেষত ১৯২০-৩০-এর দশকে বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে আরও অবনতি ঘটায়। 

 

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি ও সাম্প্রদায়িকতার চূড়ান্ত পরিণতিঃ সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ১৯৪৭ সালে, যখন ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়। এই বিভক্তির সময় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয়। 

 

ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান কৌশল ছিল। ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতীয় সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে এবং এ বিভক্তির ফলে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তিসহ ভয়াবহ দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সাম্প্রদায়িকতার বীজ আজও ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করছে। সুতরাং, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল শাসনের সুবিধার্থে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করা, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আজও বিদ্যমান।

 

Links

Home

Exams

Live Exam

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD