নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

ভূমিকা: ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল এক গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কার ও প্রথার বেড়াজালে আবদ্ধ। নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কারণে তারা শোষণ, নির্যাতন ও অবমাননার শিকার ছিল। নারীদের শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না, এবং সামাজিকভাবে তারা একেবারে নিচু অবস্থানে ছিল। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দুই মহান সমাজ সংস্কারক, রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নারীদের মুক্তি এবং সমাজের অন্ধকার দূর করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নারীশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের জন্য তারা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তা আজও স্মরণীয়।

নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা:

১. শিক্ষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা: রাজা রামমোহন রায় নারীদের শিক্ষার সমান অধিকারের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীদের শিক্ষাবঞ্চিত রেখে সমাজের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন এবং নারীদের শিক্ষার প্রসারে বিশেষভাবে সচেষ্ট হন।

আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব

২. নারী কল্যাণ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই: রামমোহন রায় সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি নারী জাতিকে পিছিয়ে থাকা, শোষিত এবং অবহেলিত অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য নারী শিক্ষার প্রসারের দিকে নজর দেন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য তিনি যুক্তি এবং শাস্ত্রীয় প্রমাণের মাধ্যমে প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেন।

৩. নারীর সম্পত্তির অধিকার: তৎকালীন সমাজে নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। রামমোহন রায় নারীদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। নারীদের যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং সমাজে সমান সুযোগ পায়, সেই লক্ষ্যে তিনি কাজ করেন।

৪. সতীদাহ প্রথা রোধ: তৎকালীন সমাজে নারীদের জন্য অত্যন্ত নির্মম একটি প্রথা ছিল সতীদাহ। স্বামী মারা গেলে, স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। রামমোহন রায় এই নিকৃষ্টতম প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন এবং এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন। ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সময় সতীদাহ প্রথা রোধে আইন প্রণয়ন করা হয়, যা রামমোহনের অগ্রণী ভূমিকার ফলাফল।

৫. ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা: ১৮২৮ সালে রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা নারী শিক্ষার প্রসারে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে। ব্রাহ্ম সমাজের মাধ্যমে তিনি নারীদের শিক্ষার প্রসার এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে উদ্বুদ্ধ করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা:

১. বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও নারীশিক্ষার প্রসার: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৮৪৯ সালে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা মেয়েদের শিক্ষার জন্য প্রথম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়। এই উদ্যোগ নারীদের জন্য শিক্ষার দরজা খুলে দেয় এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ভূমিকা রাখে। তিনি নারী শিক্ষার জন্য সমাজে ব্যাপক প্রচার চালান এবং এই বিষয়ে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন।

আরো পড়ুনঃ ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের গুরুত্ব

২. বিধবাবিবাহ প্রচলন: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিধবা নারীরা তৎকালীন সমাজে অত্যন্ত নিগৃহীত ছিল। বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রথা না থাকায় তারা অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় দিন কাটাত। বিদ্যাসাগর এই অনৈতিক এবং অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়, যার ফলে বিধবা নারীরা পুনর্বিবাহের অধিকার লাভ করে।

৩. নারী শিক্ষার প্রসারে আর্থিক সহায়তা: বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই থেমে থাকেননি, তিনি নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য ‘নারী শিক্ষা ভাণ্ডার’ নামক একটি তহবিল গঠন করেন। এই তহবিলের মাধ্যমে তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক কাজ করেন এবং দরিদ্র মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ দেন। তিনি নারীদের লেখাপড়ার জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করেন।

৪. নারী শিক্ষার জন্য পাঠ্যক্রম ও ভাষা মাধ্যম নির্ধারণ: বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করেন, যেখানে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানেই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব।

৫. বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই: বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি মেয়েদের শিক্ষার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের প্রথার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি মেয়েদের লেখাপড়ার মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী হতে এবং বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেতে প্রেরণা দেন।

আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পদ্ধতি কাকে বলে?

উপসংহার: রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উভয়েই নারী কল্যাণ এবং সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রামমোহন রায় নারীদের সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রথার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন এবং বিদ্যাসাগর নারীদের জন্য শিক্ষার আলো প্রজ্বলিত করেছেন। তাদের প্রচেষ্টার ফলেই নারীরা সামাজিক এবং শিক্ষাগত ক্ষেত্রে অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে, যা আজও ভারতীয় সমাজে নারী মুক্তির এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252