নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধাসমূহ আলোকপাত কর।
ভূমিকাঃ সাম্প্রতিককালের উন্নয়ন ভাবনায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তথা বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি বেশ জোরেসোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সমতার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের অধিকার মর্যাদার সমতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ক্ষমতায়নঃ ক্ষমতায়ন উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে Empowerment শব্দটি একটি জনপ্রিয় পরিভাষা হয়ে উঠে এবং তা কল্যাণ, উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ, দারিদ্র্য বিমোচনের মত শব্দগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয়। সামাজিক অসমতা দূর করে নিপীড়িত বঞ্চিতদের অধস্তনতা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টাই হল Empowerment. অন্যকথায়, ক্ষমতায়ন বলতে তিন ধরনের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণকে বুঝায়। যথা: বস্তুগত সম্পদ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ এবং আদর্শিক সম্পদ। এ তিন ধরনের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই ক্ষমতায়ন।
আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
নারীর ক্ষমতায়নঃ সাধারণত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নারীকে সরাসরি অংশগ্রহণ করানোর প্রক্রিয়াকে নারীর ক্ষমতায়ন বলা হয়। আবহমান কাল ধরে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টি দিক হল, প্রথমত, নারী ও পুরুষের মধ্যে ভিন্নতা। দ্বিতীয়ত, পুরুষের তুলনায় নারীর সীমিত অধিকার। এসব বৈষম্যের কারণে নারীরা আজ সামাজিক, অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিরাজমান সকল অসমতা ও বৈষম্য দূর করে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় সমমানে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব তাকেই নারীর ক্ষমতায়ন বলা হয়।
বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে বাধা সমূহঃ বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে নানা প্রকার বাধা পরিলক্ষিত হয় নিম্নে তা আলোচনা করা হলোঃ
১. পুরুষদের দাসত্ব করার মানসিকতাঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরুষদের উপর নির্ভরশীল। এর প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা। এই অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে নারীরা সর্বদা নিজেদেরকে পুরুষদের তুলনায় হেয় মনে করে ও পুরুষদের উপর নির্ভর করাকে প্রাধান্য দেয়। এই মানসিকতার ফলে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হয় না।
২. সম্পদের প্রতি নগণ্য অধিকারঃ বাংলাদেশে দেখা যায় যে, নারী তার পিতার সম্পদে পুরুষদের মত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না এবং অনেকক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত হয়। ফলে নারীরা অধস্তনই রয়ে যায় এবং তাদের ক্ষমতায়ন সম্ভব হয় না।
৩. বেকারত্বঃ বাংলাদেশের পুরুষদের যত কাজের ক্ষেত্র আছে নারীদের তেমনটা নেই। ফলে নারীদের কর্মহীন থাকতে হয় এবং পুরুষ নির্ভরশীলতা বাড়ে যা নারীর ক্ষমতায়নে বাঁধা হিসেবে দাড়ায়।
আরো পড়ুনঃ বিভারিজ রিপোর্টের পঞ্চদৈত্য ও সুপারিশসমূহ
৪. ভারসাম্যহীন ক্ষমতা কাঠামোঃ আমরা যদি আমাদের দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রসমূহের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব যে, স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় সরকার পর্যন্ত সর্বত্র পুরুষদের বিপুল সংখ্যাধিক্য। একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যদি ক্ষমতা কাঠামোতে পুরুষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে সেখানে পুরুষালি মনোভাব কার্যকরী হওয়ার প্রবণতা থাকবেই, যা প্রকারান্তরে নারীর ক্ষমতায়নের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে।
৫. নিরাপত্তাহীনতাঃ নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান নারীর গতিশীলতা বিরোধী সংস্কৃতি ও বিদ্বেষমূলক ধারণার দাপট তো আছেই। তার সাথে আছে নারীর নিরাপত্তাহীনতা। নিরাপত্তা পাওয়া ও নারীর চলাফেরার অধিকার যদিও বা আমাদের দেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত অধিকার কিন্তু তা ব্যবহারের সুযোগ যে কত সংকুচিত একমাত্র ভুক্তভোগীরাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
৬. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণহীনতাঃ আমাদের দেশের নারীরা অর্থনৈতিকভাবে একটা নির্ভরশীল সমাজ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছে। আর নগদ অর্থ উপার্জন করতে না পারাটাই নির্ভরশীলতার মুখ্য কারণ। পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার অপরিহার্য পরিণাম হিসেবে মেয়েরা শুধু নগদ অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রসমূহে প্রবেশ করতে বাধা পায় তা নয়, যেখানে মেয়েরা নগদ অর্থ উপার্জন করে সেখানে পরিবারের পুরুষ প্রধানরাই তা নিয়ন্ত্রণ করে।
৭. সামাজিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাঃ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীদেরকে শুধুমাত্র Reproductive role এ দেখতে অভ্যস্ত, Productive role এ নয়। নারীদের কোনরূপ সামাজিক অধিকার থাকতে পারে তা প্রচলিত সমাজ বুঝতে অক্ষম। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার কারণেও মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি সাড়া দেয়। সেও চায় যে, তার আচরণগুলো পরিবারের ও সমাজের অন্যান্য সদস্য কর্তৃক সমর্থিত ও গ্রহণযোগ্য হোক।
৮. বিদ্বেষমূলক প্রচারণাঃ নারীর অসুবিধার জন্য পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষশাসিত সমাজই দায়ী। এ ক্ষোভ থেকেই অধিকার সংগ্রামী এক শ্রেণির নারী এমনভাবে পুরুষশ্রেণিকে দায়ী করে বক্তব্য দেন এবং প্রচার প্রচারণা চালান যাতে করে নারী অধিকার সংগ্রামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক উদারপন্থি লোক আহত হয় ও ক্ষুব্ধ হয়, যা বস্তুত নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৯. এক পাক্ষিক উদ্যোগঃ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রায় সকল উদ্যোগ ও আয়োজন নারীরাই করছে। এখানে পুরুষদের সম্পৃক্ততা খুবই নগণ্য। পুরুষদের যেটুকু সংশ্লিষ্টতা আছে তা মূলত প্রতিষ্ঠানভিত্তিক অথচ নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে সমগ্র সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। সুতরাং, নারীসমাজের যে কোন উন্নয়ন যে সামগ্রিক মানব উন্নয়নের পরিপূরক তা সকলকে বুঝতে হবে। আর তাই এক পাক্ষিক উদ্যোগকে নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রতিবন্ধক মনে করা হয়।
১০. সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতাঃ আমরা নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বিভিন্ন মহলের সম্পৃক্ততার কথা যতই গুরুত্ব দিয়ে বলি না কেন, চূড়ান্ত গুরুত্ব কিন্তু নারীসমাজের নিজস্ব উদ্যোগ আয়োজনে। আসলে সবকিছু করতে হবে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায়। যৌথ প্রচেষ্টায় এবং নিয়মতান্ত্রিকতার মাধ্যমে রাজনৈতিক মত ও পথ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বজনীনভাবে ন্যায্য ও কাঙ্ক্ষিত নারী অধিকারগুলো আদায়ে তেমন সরব ও সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে পারছে না। যা প্রকারান্তরে নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে এক প্রকার পরোক্ষ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পরিচিতি সাজেশন Exam-2024
১১. নেতৃত্ব পর্যায়ে যথার্থ গতিশীলতার অভাবঃ নেতা হওয়া আর নেতৃত্ব দেওয়া কিন্তু এক জিনিস নয়। অনেক পথে নেতা হওয়া যায়। অথচ নেতৃত্বটা কিন্তু এমন নয়। এটা অর্জন করতে হয়, যার জন্য অনেক গুণাবলি থাকতে হয়, যেসব গুণাবলির শক্তিতে একটি সংগঠনকে সুচারুরূপে পরিচালনা করা যায়। আমাদের দেশের নারী নেতৃত্বের মধ্যে যথাযথ গতির অভাব রয়েছে। যে কারণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, আয়োজন ও কর্মতৎপরতা পরিচালনায় ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়, যা প্রকারান্তরে নারীর ক্ষমতায়নের পথকেই বাধাগ্রস্ত করে।
১২. সুশীল সমাজের অনাসক্তিঃ আমাদের দেশে যাদেরকে সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করি, যাদেরকে জাতির বিবেক বলতে আমরা পছন্দ করি, তাদের পক্ষ থেকে কখনও কখনও কিছু বিবৃতি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালায় আমন্ত্রিত হয়ে কিছু জ্ঞানগর্ব বক্তৃতা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে কোন উদ্যোগ বা জোরালো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না। অথচ এটা তাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত বাসনা। সক্ষমতা, সামর্থ্যতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন না করা এটাই নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বড় প্রতিবন্ধকতা।
১৩. প্রচলিত আইনের অধিকার ও সীমাবদ্ধতাঃ বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭নং ধারা মতে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে বর্ণিত প্রথম উদ্দেশ্য ও সকল স্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামো ও ক্ষমতায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জন করা। তারপরও এটাকে পর্যাপ্ত ও যুগোপযোগী বলা যাবে না। প্রচলিত আইনসমূহের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেকগুলো আইন এখনও বর্তমান আছে যেগুলো নারীর সমানাধিকারের সাথে বিরোধপূর্ণ ও অসঙ্গতিপূর্ণ, যা নারীর ক্ষমতায়নের পথকে অবশ্য বাধাগ্রস্ত করছে।
১৪. নারীসমাজের অসচেতন ও শিক্ষার অভাবঃ আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার রেশ কম। এক্ষেত্রে নারীদের অবস্থা আরও খারাপ। ফলে নারীসমাজের মধ্যে অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অন্যান্য ধ্যানধারণা লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টা শুধু এ পর্যায়েই থেমে থাকে নি, শিক্ষাহীনতার কারণে দেশের বেশিরভাগ নারী বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়ায় তাদের সমস্যা, সমস্যার কারণ ও উৎস এবং সমাধান প্রক্রিয়া সম্পর্কে শুধু যথাযথভাবে ভাবতেই পারে না তা নয়, তারা তাদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বুঝতে খুব একটা সচেতন নয়। এ শিক্ষাহীনতা ও অসচেতনতাই নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অন্যতম প্রতিবন্ধক।
১৫. দারিদ্র্যতার অভিশাপঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোই যে নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রধান বাধা তাতে। দ্বিমত করার কিছু নেই। তবে এর সাথে নারীর ক্ষমতাহীনতার কারণ হিসেবে দারিদ্র্যতার দুষ্টজালের ভূমিকাও স্মরণ রাখা বোধ করি প্রয়োজন। সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, দারিদ্র্যতার অভিশাপ নারী ও পুরুষ উভয়কে নির্যাতন তুলনামূলক বিচারে বেশি হয়। তাই বলা হয়, দারিদ্র্যতা বিত্তহীন নারীসমাজের ক্ষমতায়নের পথে অন্যতম সমানভাবে স্পর্শ করে। লক্ষ্য দেখা যাবে যে, দারিদ্র্য পরিবারগুলোতে নারীর জীবনে অশান্তি, নিপীড়ন, করলে বড় প্রতিবন্ধক।
নারীর ক্ষমতায়নে যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া দরকারঃ নারীর ক্ষমতায়নে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে।
১. ধর্মীয় ও কৌশলগত ক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর ক্ষমতায়নকে প্রাধান্য দেওয়া।
২. নারীর ক্ষমতায়নে অর্থনৈতিক বাঁধা অপসারণ করা।
৩. নারীদের মাতৃত্ব সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা।
৪. নারী শিক্ষা নিশ্চিত করা।
৫. পুরুষদের কর্তৃত্ব কমিয়ে আনা।
৬. নারীদের সুবিধায় যথার্থ আইন প্রণয়ন করা।
৭. নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করা।
৮. নারীদের আত্মনির্ভরশীল হতে শেখা।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আমাদের সমাজ নারীর ক্ষমতায়নে নানা বাঁধায় পূর্ণ। মূলত নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন করতে চাইলে অবশ্যই যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সকল বাঁধা অপসারণ করতে হবে এবং কেবল তখনই আমরা – নারীর ক্ষমতায়নের সুফল পাব।