এরিস্টটলকে কেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়?

এরিস্টটলকে কেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়? অথবা, রাজনৈতিক চিন্তাধারায় এরিস্টটলের অবদান আলোচনা কর।

ভূমিকা: মহান গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলকে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত করা হয়। তাঁর বিশ্লেষণাত্মক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনন্য স্থান অর্জন করেছে। ৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের স্ট্যাগিরাতে জন্মগ্রহণ করা এরিস্টটল প্লেটোর শিষ্য ছিলেন। এরিস্টটল প্রথম ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে সুসংহতভাবে বিশ্লেষণ করে এটিকে একটি পৃথক জ্ঞান শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরিস্টটলের অসাধারণ অবদান তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে, যা আজও সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গ্রহণ করে থাকেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে এরিস্টটল: এরিস্টটল প্রথম ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে উপস্থাপন করেন এবং এটিকে স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তার বিখ্যাত বই “The Politics”-এ তিনি রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সরকার, শাসনব্যবস্থা, এবং ন্যায়বিচারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। এরিস্টটল রাষ্ট্রকে একটি সংহত প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে চেয়েছেন এবং এর কার্যক্রমগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার উপসংহার টেনেছেন।

আরো পড়ুনঃ সংবিধান কি? উত্তম সংবিধানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এরিস্টটলের অবদান: নিম্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এরিস্টটলের উল্লেখযোগ্য অবদানগুলো আলোচনা করা হলো—

১. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি পৃথক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা: এরিস্টটল প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক করে এটিকে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো এবং এর কার্যক্রমকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সর্বোচ্চ জ্ঞান শাখা হিসেবে মর্যাদা দেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্য “Master of Science” বা সর্বোচ্চ বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

২. ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি: এরিস্টটল মনে করতেন যে, রাষ্ট্রে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। তিনি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে ছিলেন এবং সরকারে বিভিন্ন দায়িত্ব পৃথক করার পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির প্রাথমিক ধারণা।

৩. বিপ্লবের তত্ত্ব: এরিস্টটল প্রথম বিপ্লব সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেন। তিনি বলেছিলেন, যখন মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তারা বিপ্লবের পথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরিস্টটল বিপ্লব প্রতিরোধের এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর বিপ্লবের তত্ত্ব আজও রাজনীতির অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ।

৪. আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক শাসন: এরিস্টটল সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তার মতে, একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইন ও সংবিধানের নিয়ম মেনে চলা জরুরি। তিনি মনে করতেন, যেখানে আইন নেই, সেখানে শাসনের কোনো অর্থ নেই।

৫. আইনের সার্বভৌমত্ব: এরিস্টটল ব্যক্তিগত সার্বভৌমত্বের চেয়ে আইনের সার্বভৌমত্বকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, রাষ্ট্রের শক্তি তার আইন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিত, ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী নয়। তার এই ধারণা থেকেই আধুনিককালে আইনের শাসনের ধারণা প্রসারিত হয়েছে।

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা

৬. রাষ্ট্রের লক্ষ্য নির্ধারণ: এরিস্টটল বলেছেন, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো নাগরিকদের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের নৈতিক ও জ্ঞানগত উৎকর্ষ সাধন। তিনি মনে করতেন, একটি ভাল রাষ্ট্রের কাজ হলো তার নাগরিকদের নৈতিকভাবে উন্নত করা এবং তাদের সুখ নিশ্চিত করা।

৭. শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: এরিস্টটল শিক্ষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক তৈরি করা সম্ভব। তার মতে, শিক্ষা একটি রাষ্ট্রের মঙ্গল এবং স্থিতিশীলতার প্রধান শর্ত।

৮. সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য: এরিস্টটল প্রথম ব্যক্তি যিনি সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, সরকার পরিবর্তনশীল, কিন্তু রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। তাঁর এই ধারণা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

৯. কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা: প্লেটো দার্শনিকদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু এরিস্টটল জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলেছেন। তার মতে, রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের সুখ ও মঙ্গল নিশ্চিত করা এবং সকল নাগরিকের জীবনকে অর্থবহ করা।

১০. স্থিতিশীল সরকারব্যবস্থা: এরিস্টটল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং স্থায়ী সরকারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একটি রাষ্ট্র যতক্ষণ স্থিতিশীল থাকবে, ততক্ষণই তার উন্নয়ন সম্ভব হবে। স্থিতিশীল সরকার একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।

১১. সরকারের শ্রেণীবিভাগ: এরিস্টটলই প্রথম ব্যক্তি যিনি সরকারকে গুণগতভাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। তিনি সরকারকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন— কল্যাণকর সরকার এবং অকল্যাণকর সরকার। তার মতে, সরকার যদি জনগণের মঙ্গল চিন্তা করে, তবে তা কল্যাণকর; আর যদি তা স্বার্থপরতায় পরিচালিত হয়, তবে তা অকল্যাণকর। এই শ্রেণীবিভাগ আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।

আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা

১২. বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি: এরিস্টটল ছিলেন একজন বাস্তববাদী দার্শনিক। তিনি রাষ্ট্রের কার্যক্রম ও সমস্যাগুলোকে বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন এবং সমাধানের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রস্তাব করেছেন। তার বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৩. জনমতের গুরুত্ব: যদিও এরিস্টটল সরাসরি গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না, তবে তিনি জনমতের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তার মতে, জনগণের মতামত একটি সরকারের সফল পরিচালনার মূল চাবিকাঠি। তিনি মনে করতেন, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সরকার পরিচালনা করা উচিত।

উপসংহার: এরিস্টটলের অবদান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিকাশে অমূল্য। তার চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী। রাষ্ট্রের কাঠামো, শাসনব্যবস্থা, বিপ্লবের কারণ এবং আইনের শাসনের প্রতি তার অবদান তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণাগুলোতে এরিস্টটলের চিন্তাধারার স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে, যা তাকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে স্থাপন করেছে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263