জাতি ও জাতীয়তাবাদ কাকে বলে?

জাতি ও জাতীয়তাবাদ কাকে বলে?

ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বে ‘জাতি’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দ দুটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সাধারণভাবে এগুলো প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এগুলো নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়। জাতি বলতে বোঝায় যে জনসমাজ একত্রে বসবাস করে এবং তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনা থাকে। আর জাতীয়তাবাদ হলো সেই চেতনাভিত্তিক একটি ধারণা যা মানুষকে একত্রিত করে।

জাতি কী? 

ইংরেজি ‘Nation’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘জাতি’। ‘Nation’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Natio’ বা ‘Natus’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ জন্ম। সুতরাং, ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জাতি বলতে বুঝায় একই বংশোদ্ভূত বা এক উৎস থেকে আসা জনসমাজকে। তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতি বলতে বোঝায়, একটি নির্দিষ্ট ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী জনসমাজ, যারা নিজেদের পৃথক পরিচয় এবং সার্বভৌমত্ব দাবি করে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: নানান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাতির ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা হলো:

  • অধ্যাপক হায়েস বলেছেন, “একটি জাতীয় জনসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সার্বভৌম স্বাধীনতা অর্জন করলে জাতিতে পরিণত হয়।”
  • অধ্যাপক ম্যাকাইভার বলেন, “জাতি হলো ঐতিহাসিক পরিস্থিতির দ্বারা স্পষ্ট এবং অধ্যাত্মচেতনার দ্বারা সমর্থিত একত্রে বসবাস করার সংকল্পবদ্ধ সম্প্রদায়।”

জাতীয়তাবাদ: জাতীয়তাবাদ বলতে বোঝায়, জাতি বা জাতীয়তা থেকে উদ্ভূত একটি মানসিক এবং সামাজিক অনুভূতি, যা একই জাতির লোকদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করে। জাতীয়তাবাদ একটি চেতনা, যা এক জনগোষ্ঠীকে অন্যের থেকে আলাদা করে এবং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।

আরো পড়ুনঃ রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ

  • জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, “জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠী তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতির দ্বারা আবদ্ধ হয় এবং নিজেদের একদর্শী সরকারের অধীনে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে।”
  • অধ্যাপক লাস্কি বলেন, “জাতীয়তাবাদ হলো এক ধরনের মানসিকতা, যা প্রাচীন স্মৃতি এবং ভবিষ্যৎ একত্রে থাকার সম্মতি থেকে পুষ্ট হয়।”

জাতীয়তাবাদের উপাদানসমূহ:

১. ভাষাগত ঐক্য: ভাষা হলো মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। ভাষা জনগণের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান ও অভিন্ন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। একই ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে একটি শক্তিশালী ঐক্য গড়ে ওঠে। যদিও ভাষা একমাত্র উপাদান নয়, তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মতো দেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী হলেও তারা একই জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে।

২. বংশগত ঐক্য: একই বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক ও একাত্মতা থাকে, যা তাদের জাতীয়তাবোধকে দৃঢ় করে। বংশগত ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজগুলোতে সহজেই জাতীয়তাবোধ তৈরি হয়।

৩. একই শাসনব্যবস্থা: দীর্ঘদিন ধরে একই শাসনব্যবস্থার অধীনে বসবাস করলে জনগণের মধ্যে জাতি গঠনের স্পৃহা জাগ্রত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এর উদাহরণ যেখানে বিভিন্ন জাতি এক শাসনব্যবস্থার অধীনে জাতি গঠন করেছে।

৪. ধর্মীয় ঐক্য: ধর্ম মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। একই ধর্মে বিশ্বাসী জনগণের মধ্যে একাত্মবোধের সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনা জাগ্রত করে। তবে ধর্মই জাতীয়তাবাদের একমাত্র উপাদান নয়, তবে এর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।

৫. অর্থনৈতিক ঐক্য: অর্থনৈতিক একাত্মবোধ জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে। যখন জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ অভিন্ন হয়, তখন তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনা জাগ্রত হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য জাতিগত বিভেদকে উসকে দিতে পারে।

৬. রাষ্ট্রীয় ঐক্য: একটি রাষ্ট্রের অধীনে জনগণের ঐক্যবদ্ধতা জাতীয়তাবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাষ্ট্র জনগণের মধ্যে অভিন্ন চেতনার বিকাশ ঘটায় এবং তাদের একই জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করে।

৭. ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐক্য: একই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতি জাতির আত্মপরিচয় গঠনে ভূমিকা পালন করে। এটি মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য তৈরি করে, যা জাতীয়তাবোধের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা

৮. ভৌগোলিক ঐক্য: ভৌগোলিক অবস্থান জাতি গঠনে সাহায্যকারী একটি প্রধান উপাদান। একই ভূখণ্ডে বসবাস করা জনগণের মধ্যে অভিন্ন চেতনার সৃষ্টি হয়। এটি তাদের মধ্যে প্রগাঢ় জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে। উদাহরণস্বরূপ, একই ভূগোলের মধ্যে বসবাস করা জনগণের মধ্যে অভিন্ন চেতনা জাগ্রত হয়।

উপসংহার: জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা, যা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং সার্বভৌমত্বের দাবিকে জোরদার করে। জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলো জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য। জনগণের একাত্মতা, ভাষা, ধর্ম, বংশগত ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক চেতনার ওপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252