তৃতীয় বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করো
ভূমিকাঃ বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। এটি বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশকে প্রভাবিত করে।অন্যভাবে বললে, বিশ্বায়ণ হল সাড়া বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে শাসন করার নতুন অথনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কৌশল। বিশ্বায়ণ হল দুবল রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রনের জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলোর অথনৈতিক ধারণা।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বায়ন এর ধারণা পাল্টে গেছে। এখন বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করছেন। এখানে তার কিছু নমুনা দেওয়া হলো:
Sociologists Martin Albrow and Elizabeth King এর মতে “all those processes by which the people of the world are incorporated into a single world society.”
উইকিপিডিয়া প্রদত্ত সংজ্ঞাটি হলো: “পরিবহন ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বিশেষ করে ১৮০০ শতকের প্রথমার্ধে বাষ্পীয় পোত ও টেলিগ্রাফের উন্নয়নের পর থেকে বিশ্বব্যাপী মানুষ বা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধির যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, তাকে বিশ্বায়ন বলে।”
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে সমাজকর্মের বৈশিষ্ট
সমাজবিজ্ঞানী মার্টিন আল ব্রো এর মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি সামগ্রিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্ত মানুষকে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া।
অনিতা রডিস এর মতে, অর্থনৈতিক উদারীকরণ যেমন, নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ, বেসরকারিকরণ এবং অধিকতর মুক্ত বিশ্ব বাণিজ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনেতিক ব্যবস্থার সাথে সংহতিকরণের অর্থ হচ্ছে বিশ্বায়ন।
এম. ওয়াটারস এর মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যাতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাধীনে ভৌগোলিক দূরত্ব কমে আসার বাধা অপসারণ করে এবং যাতে জনগণ পিছিয়ে যাওয়া সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়।
বিশ্বায়নের মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ: বিশ্বায়নের নানামুখী বৈশিষ্ট রয়েছে। তম্মধ্যে এখানে কিছু আলোচনা করা হলো:
অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন: বিশ্বায়নের প্রধান বৈশিষ্ট হলো পণ্য, পরিষেবা, মূলধন, এবং শ্রমের অবাধ আন্তর্জাতিক প্রবাহ সৃষ্টি করা।
রাজনৈতিক বিশ্বায়ন: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন: বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ও মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি।
পরিবেশগত বিশ্বায়ন: বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত সমস্যার প্রতি বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পদ্ধতি কাকে বলে?
বিশ্বায়ন হলো একটি জটিল প্রক্রিয়া যার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত বিনিময় এবং তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাবসমূহ:
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে পণ্য ও সেবার দাম কমেছে এবং ভোক্তাদের সুবিধা হয়েছে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
প্রযুক্তিগত বিনিময় বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে প্রযুক্তিগত বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন পণ্য ও সেবা তৈরি হয়েছে।
তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও গবেষণা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে।
দারিদ্র্য হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।
বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাবসমূহ:
অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে।
পরিবেশ দূষণ: বিশ্বায়নের ফলে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যা দেখা দিয়েছে।
সংস্কৃতি বিলুপ্তি: বিশ্বায়নের ফলে স্থানীয় সংস্কৃতি বিলুপ্তির ঝুঁকি বেড়েছে।
শ্রমিক অধিকার হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে শ্রমিক অধিকার হ্রাসের ঝুঁকি বেড়েছে।
আরো পড়ুনঃ সমাজসেবা কাকে বলে? সমাজসেবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
রাজনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে রাজনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাসের ঝুঁকি বেড়েছে।
বিশ্বায়নের প্রভাব মূলত একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই রয়েছে। বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাবগুলিকে কাজে লাগানোর জন্য এবং নেতিবাচক প্রভাবগুলিকে হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্বায়নের প্রভাব মোকাবেলায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে:
অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস: বিশ্বের সব দেশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করা এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
পরিবেশ দূষণ রোধ: পরিবেশ সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা।
সংস্কৃতি বিলুপ্তি রোধ: স্থানীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া।
শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা: শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক আইন ও সনদগুলিকে বাস্তবায়ন করা।
রাজনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
উপসংহার: বিশ্বায়ন একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া। এর যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে তেমন নেতিবাচক দিকও রয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোর প্রতি এর নেতিবাচক প্রভাব অতিমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়. উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় এই দেশগুলো নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়. মানবজাতির প্রকৃত উন্নয়নের স্বার্থে উন্নত দেশগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে এবং এই নিগৃহীত জাতিগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করতে হবে ।