বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাসের আলোচনা কর।

Shihabur Rahman
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাসের আলোচনা কর।
ভূমিকা:
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ বহুমাত্রিক
ও জটিল সামাজিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী তাদের
পেশা, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিতে বিভিন্ন
স্তরে বিভক্ত। এই স্তরবিন্যাসের ফলে সমাজে শ্রেণিবিভেদ, ক্ষমতার বৈষম্য ও আর্থ-সামাজিক
বিভক্তি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। গ্রামীণ সমাজের এই স্তরবিন্যাস দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি
ও ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বাংলাদেশের
গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস
১. ভূস্বামী শ্রেণি:
বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে ভূস্বামী শ্রেণি গ্রামীণ সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করে।
এই শ্রেণির লোকেরা সাধারণত অনেক কৃষি জমির মালিক। অনেক জমির মালিক হওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক
ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তারা সমাজের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।
২. মধ্যম স্তরের কৃষক:
মধ্যম স্তরের কৃষকেরা সাধারণত স্বল্প থেকে মাঝারি পরিমাণ জমির মালিক। তারা নিজেরা কৃষিকাজ
পরিচালনা করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ করে। এই শ্রেণি গ্রামীণ অর্থনীতিতে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং গ্রামীন সম্প্রদায়ে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
৩. ক্ষুদ্র কৃষক ও প্রান্তিক
কৃষক: এরা সাধারণত এক থেকে দুই বিঘা জমির মালিক, যা তাদের পরিবারের চাহিদা পূরণের
জন্য যথেষ্ট নয়। তারা কৃষিকাজের পাশাপাশি অন্য পেশায় যুক্ত থাকে, যেমন; দিনমজুরি,
ছোট ব্যবসা বা পশুপালন। এদের জীবনযাত্রা খুবই কঠিন এবং তারা প্রায়শই দারিদ্র্যের শিকার
হয়।
৪. কৃষিশ্রমিক ও ভূমিহীন
কৃষক: এরা গ্রামীণ সমাজের নিম্ন স্তরের অন্তর্ভুক্ত। কৃষিজমি না থাকায় তারা অন্যের
জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এদের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক এবং তারা সামাজিকভাবে
সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও নির্যাতিত হয়।
৫. হস্তশিল্প ও কুটির
শিল্পের শ্রমিক: বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে হস্তশিল্প, তাঁত, কামার, কুমোর, জেলে, কাঁসার কাজের প্রচলন রয়েছে।
এই পেশার মানুষরা সমাজে বিশেষ স্থান দখল করে রাখলেও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা
শক্তিশালী নয়।
৬. ব্যবসায়ী ও মহাজন
শ্রেণি: গ্রামীণ সমাজে ব্যবসায়ী ও মহাজনেরা মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী
হয়ে থাকে। তারা কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়, ঋণ প্রদান এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে
সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। অনেক সময় তারা উচ্চবিত্ত ভূস্বামী শ্রেণির সাথেও সম্পৃক্ত
থাকে।
৭. গ্রামের শিক্ষক ও
সমাজসেবক: শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী শিক্ষক ও সমাজসেবক
শ্রেণি গ্রামীণ সমাজে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়। তারা মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি
করে এবং গ্রামীন উন্নয়নে অবদান রাখে। তাদের উপস্থিতি গ্রামীণ সমাজকে গতিশীল করে।
৮. মৌলভী ও ধর্মীয়
নেতা: গ্রামের ধর্মীয় নেতারা যেমন; ইমাম, মৌলভী বা পুরোহিত সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করেন। তারা ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান
করে এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশনা দেয়। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে
তারা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তাঁরা সমাজের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেন।
৯. হাজী ও জমিদার বংশের
বংশধরগণ: অনেক গ্রামে ঐতিহ্যগতভাবে জমিদার বংশের মানুষরা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
যদিও জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে তবুও তাদের সামাজিক অবস্থান এখনো শক্তিশালী। তারা
স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১০. নারীর সামাজিক অবস্থান:
গ্রামীণ সমাজে নারীদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তারা সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার
হয়। শিক্ষার প্রসার এবং নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ার ফলে বর্তমানে তারা অনেক ক্ষেত্রে
উন্নতি সমৃদ্ধি অর্জন করছে। তবে
অনেক নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
১১. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের
ভূমিকা: বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী গ্রামীণ সমাজে বসবাস করে। তাদের
মধ্যে সাঁওতাল, গারো, হাজং, রাজবংশী প্রভৃতি সম্প্রদায় রয়েছে। তারা সাধারণত কৃষিকাজ,
হস্তশিল্প ও অন্যান্য শ্রমসাধ্য পেশার সঙ্গে জড়িত।
১২. গ্রাম্য রাজনীতি
ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ: গ্রামীণ সমাজে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য
ও চেয়ারম্যানরা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। তারা স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখে এবং কখনো কখনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে।
১৩. গ্রামের তরুণ সমাজ
ও তাদের ভূমিকা: তরুণ সমাজ গ্রামীণ সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে। তারা শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে
অংশগ্রহণ করে থাকে। তবে বেকারত্ব ও মাদকাসক্তির মতো সমস্যাগুলি তাদের অগ্রগতিতে প্রতিনিয়ত
বাধার সৃষ্টি করছে।
১৪. প্রবাসী শ্রেণি
ও তাদের প্রভাব: অনেক গ্রামবাসী কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ যায়। প্রবাসীদের পাঠানো
রেমিট্যান্স গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙা করে এবং অনেক পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তুলে।
তারা নতুন প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির সমন্বয় করে যা গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা
পালন করে।
১৫. স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী
শ্রেণি: গ্রামীণ সমাজে ডাক্তার, কম্পাউন্ডার, কবিরাজ ও পল্লী চিকিৎসকেরা মানুষের
চিকিৎসা সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা
কর্মসূচি চালু থাকলেও এখনো অনেক গ্রামে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাব রয়েছে।
১৬. পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের
প্রভাব: বর্তমানে গ্রামীণ সমাজ আধুনিক প্রযুক্তি, ডিজিটাল যোগাযোগ ও উন্নত কৃষিপদ্ধতির
মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে। শিক্ষার প্রসার, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সুবিধার ফলে মানুষের
জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। তবে আধুনিকতার পাশাপাশি ঐতিহ্য সংরক্ষণ করাও একটি বড়
চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক
স্তরবিন্যাস দীর্ঘদিনের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে
গড়ে উঠেছে। সময়ের সাথে সাথে এই স্তরবিন্যাসে পরিবর্তন আসছে। তবে এতে
এখনো অনেক বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সুষম উন্নয়ন, শিক্ষা, ন্যায় বিচার, স্বাস্থ্যসেবার
উন্নতি ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সামাজিক স্তরবিন্যাসের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা
সম্ভব।
3
সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বলতে কি বুঝ?

Shihabur Rahman
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি?

Shihabur Rahman
মরণশীলতা ও প্রজননশীলতা বলতে কি বুঝ?

Shihabur Rahman
উপনিবেশবাদ কি?

Shihabur Rahman
গ্রামীণ সমাজের / সম্প্রদায়ের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা কর।
