বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে সম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো আলোচনা কর।

Shihabur Rahman
বাংলাদেশের
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে সম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো আলোচনা কর।
ভূমিকা:
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ দীর্ঘদিন ধরে
একটি ঐতিহ্যবাহী পিতৃতান্ত্রিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়ে আসছে।
ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামের ক্ষমতা কাঠামো মূলত জমিদার, সমাজপতি, স্থানীয় মাতব্বর, চেয়ারম্যান
এবং ধর্মীয় নেতাদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা
কাঠামোতে ব্যাপক রূপান্তর বা পরিবর্তন ঘটেছে।
বাংলাদেশের
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহ: বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর সাম্প্রতিক প্রবণতা নিম্নরূপ;
১.
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকাশ ও শক্তিশালীকরণ: স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকাশের ফলে বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। ইউনিয়ন
পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। সরাসরি নির্বাচনের
মাধ্যমে জনগণ এখন চেয়ারম্যান ও মেম্বার নির্বাচন করতে পারে, যা গণতন্ত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে।
২.
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বৃদ্ধি: আগে
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো প্রধানত স্থানীয় মাতব্বর ও অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে ছিল। বর্তমানে
রাজনৈতিক দলগুলোর উপস্থিতি গ্রামীণ রাজনীতিতে বেশি প্রভাব ফেলছে। দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন
পরিষদ ও উপজেলা নির্বাচন হওয়ার ফলে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামো দলীয় রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত
হচ্ছে।
৩.
ভূমির মালিকানার পরিবর্তন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ: একসময় জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পরেও গ্রামে জমির মালিকরাই
প্রধান ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তবে বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি
পেয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কৃষি শ্রমিকরাও ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। এটি সমাজের ক্ষমতা
কাঠামোয় বৈচিত্র্য এনেছে।
৪.
নারীর ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি: আগে
নারীরা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে ছিল। তবে কোটা ভিত্তিক নারী জনপ্রতিনিধির নির্বাচনের
সুযোগ, নারীদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির ফলে এখন নারীরা ইউনিয়ন পরিষদ
ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া, নারী নেতৃত্বে এনজিও কার্যক্রম, মাইক্রোক্রেডিট
এবং নারীবান্ধব নীতির কারণে নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫.
তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবার প্রভাব: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনের ব্যাপক
প্রভাব পড়েছে। ই-গভর্নেন্স, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন সার্ভিস এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের
ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো অনেক বেশি উন্মুক্ত ও গণমুখী হয়েছে।
আগে যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত, এখন তাদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণও তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে
ক্ষমতার অংশীদার হতে পারছে।
৬.
কৃষি ও অর্থনীতিতে পরিবর্তন: আগে
ক্ষমতা প্রধানত জমির মালিকদের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও বর্তমানে কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন,
কৃষিপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এবং সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা
ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে।
৭.
এনজিও ও বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা: বাংলাদেশের
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে বিভিন্ন এনজিও ও বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম একটি বড় পরিবর্তন
নিয়ে আসছে। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, কারিতাসের মতো সংস্থাগুলো কৃষি, শিক্ষা,
স্বাস্থ্য এবং নারী উন্নয়নে কাজ করছে, যা স্থানীয় জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করছে।
৮.
স্থানীয় সালিশ ব্যবস্থার পরিবর্তন: আগে
গ্রামে মাতব্বর, মৌলভী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নেতৃত্বে সালিশ পরিচালিত হতো। বর্তমানে
সরকারিভাবে গ্রাম আদালত চালু হওয়ায় বিচার ব্যবস্থা অধিকতর নিয়মতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ হয়েছে।
৯.
শিক্ষা ও সচেতনতার বৃদ্ধি: গ্রামীণ
জনগণের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণ এখন অধিকতর সচেতন। আগে যেখানে অল্পসংখ্যক
শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ করত, এখন শিক্ষিত তরুণরা নেতৃত্ব দিচ্ছে,
যা ক্ষমতা কাঠামোর বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করছে।
১০.
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব: আগে গ্রামের সাধারণ মানুষ সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের ওপর নির্ভর
করত। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ) প্রসারের ফলে গ্রামের
সাধারণ মানুষ সরকারি দুর্নীতি, উন্নয়ন প্রকল্প, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সরাসরি মতামত
দিতে পারছে, যা ক্ষমতা কাঠামোকে আরও গণতান্ত্রিক করছে।
১১.
গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈচিত্র্য: আগে
কৃষিই গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল। কিন্তু বর্তমানে গার্মেন্টস, রেমিট্যান্স,
ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, মোবাইল ফিনান্স এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়
গ্রামের ক্ষমতা কাঠামো বৈচিত্র্যময় হয়েছে।
১২.
গ্রাম থেকে শহরমুখী অভিবাসন ও প্রবাসী আয়ের ভূমিকা: অনেক পরিবার বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে গ্রামে তাদের
প্রভাব বেড়েছে। আগে শুধু জমির মালিকরাই সমাজে ক্ষমতাশালী ছিল, এখন বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিরাও
অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতা কাঠামোর অংশ হয়ে উঠেছে।
১৩.
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জলবায়ু
পরিবর্তন গ্রামীণ জীবনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ায়, অনেক কৃষক
অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে, যা নতুন ক্ষমতা কাঠামোর সৃষ্টি করছে।
১৪.
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা বৃদ্ধি:
আগে গ্রামীণ সমাজে অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করত। বর্তমানে
স্থানীয় প্রশাসন, গ্রাম পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির
উন্নতি ঘটছে।
১৫.
রাজনৈতিক সহিংসতা ও দখলদারিত্বের প্রবণতা: বর্তমানে গ্রামে রাজনৈতিক দলের প্রভাব অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোতে প্রভাব বিস্তার করছে, যা গণতন্ত্রের
জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।
১৬.
সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন: গ্রামীণ সমাজে আগের তুলনায় আধুনিক জীবনধারা, শিক্ষার প্রসার
এবং গণমাধ্যমের কারণে সামাজিক মূল্যবোধে পরিবর্তন এসেছে। মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত
সম্প্রীতি বাড়লেও, অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বিভেদ তৈরি করছে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে
প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কারণে ব্যাপক
রূপান্তর ঘটেছে। এই পরিবর্তন গণতন্ত্রের বিকাশ, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার
ও শিক্ষার প্রসার ঘটালেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সহিংসতা কিছু ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।
ভবিষ্যতে যদি এই কাঠামোকে আরও স্বচ্ছ ও গণমুখী করা যায়, তবে বাংলাদেশ আরও উন্নত গ্রামীণ
শাসনব্যবস্থা পাবে।
3
সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বলতে কি বুঝ?

Shihabur Rahman
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি?

Shihabur Rahman
মরণশীলতা ও প্রজননশীলতা বলতে কি বুঝ?

Shihabur Rahman
উপনিবেশবাদ কি?

Shihabur Rahman
গ্রামীণ সমাজের / সম্প্রদায়ের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা কর।
