গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো কি?

Avatar

Shihabur Rahman

Academic

গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো কি? 

ভূমিকা: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে গ্রামাঞ্চলের প্রশাসনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবক ও তাদের মধ্যে সম্পর্ককে বোঝানো হয়। এটি মূলত গ্রামীণ সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কাঠামোর চিত্র তুলে ধরে, যেখানে স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় নেতা, প্রবীণ ব্যক্তিরা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ, এবং আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামোর সংমিশ্রণে গঠিত হয়। 

 

গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো: গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থাই মূলত গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো। এর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যথা নিম্নরূপ;

 

১. প্রথাগত নেতৃত্ব: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রথাগত নেতৃত্ব। গ্রামপ্রধান, মাতব্বর, কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠরা সাধারণত এই ভূমিকা পালন করে। তারা সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি, পারিবারিক বিবাদ মীমাংসা, এবং গ্রামের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বহু গ্রামেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটি চলে আসছে।

 

২. রাজনৈতিক নেতৃত্ব: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা জনগণের মতপ্রকাশ, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে ভূমিকা রাখেন।

 

৩. প্রশাসনিক কাঠামো: সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় পুলিশ, গ্রাম পুলিশ ও ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সরকারি সুবিধা বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

৪. অর্থনৈতিক ক্ষমতা: গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জমির মালিক, বড় ব্যবসায়ী, মহাজন ও ধনী কৃষকরা সাধারণ মানুষের ওপর অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। গ্রামীণ ঋণ ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই ধনী শ্রেণি দরিদ্র কৃষকদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে।

 

৫. ধর্মীয় নেতৃত্ব ও সামাজিক প্রভাব: গ্রামের ধর্মীয় নেতা, যেমন ইমাম, পুরোহিত বা ওঝারা সমাজে বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং সামাজিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বজায় রাখতে ভূমিকা রাখেন। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর অংশ হিসেবে অনেকে সামাজিক বিচার-নিষ্পত্তিতেও অংশগ্রহণ করেন।

 

৬. সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিও: বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর অংশ হয়ে উঠেছে। তারা ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা ইত্যাদি এনজিও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

 

৭. নারীর ক্ষমতায়ন ও ভূমিকা: প্রথাগতভাবে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে নারীদের ভূমিকা তুলনামূলক কম থাকলেও, বর্তমানে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য, নারী সংগঠন ও এনজিওগুলোর মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।

 

৮. বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সালিশি ব্যবস্থা। প্রথাগতভাবে মাতব্বর বা গণ্যমান্য ব্যক্তিরা গ্রাম্য সালিশ পরিচালনা করেন, যেখানে পারিবারিক, আর্থিক, এবং সামাজিক বিরোধ মীমাংসা করা হয়। বর্তমানে প্রথাগত সালিশি ব্যবস্থা কার্যকর করতে স্থানীয় প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

উপসংহার: গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বহুস্তরবিশিষ্ট এবং এতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উপাদান একত্রে কাজ করে। যদিও প্রথাগত নেতৃত্ব এখনো গুরুত্বপূর্ণ, তবে আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো, এনজিও, রাজনৈতিক দল ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই একটি কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ সমাজে সমতা ও স্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করা জরুরী।   

 

Links

Home

Exams

Live Exam

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD