গণতন্ত্রের সফলতার শর্তগুলো লেখ।

Avatar

Shihabur Rahman

Academic

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও। গণতন্ত্রের সফলতার শর্তগুলো লেখ। 

ভুমিকা: বর্তামান বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতেন্ত্র সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষিত হয়। ফলে, নাগরিকগণ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতি অনেকটাই আস্হাশীল। তবে, বিভিন্ন দেশে এই গণতন্ত্রের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করায় গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য। নিম্মে গণতন্ত্র কি এবং এর সফলতার শর্তসমূহ আলোচনা হলো।

 

গণতন্ত্র কি: গ্রীক ভাষার শব্দ ডেমোক্র্যাটিয়া (Dēmokratía) থেকে 'গণতন্ত্র' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ডেমোক্রেটিয়া শব্দটি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত যেখানে ‘ডেমো (Demo)’ অর্থ একটি নির্দিষ্ট নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী সমগ্র নাগরিক বা জনগণ  এবং ‘ক্র্যাটোস (Kratos)’ অর্থ ক্ষমতা বা শাসন।  সুতরাং গণতন্ত্র শব্দের  অর্থ, ‘জনগণের শাসন বা জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা। বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এরিষ্টটলকে গণতন্ত্রের জনক বলা হয়। তবে, আধুনিক গণতন্ত্রের জনক হলেন জন লক।

 

গণতন্ত্রের প্রামাণ্য সংজ্ঞা: "গণতন্ত্র হল একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে জনগণ সরাসরি বা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আইন, নীতি ও নেতৃত্ব জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।" গণতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন: 

 

প্রামাণ্য সংজ্ঞা:  গণতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন যথা নিম্নরুপ;

 

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন এর মতে, “Democracy is the government of the people, by the people, for the people.” ‘‘গণতন্ত্র হল জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য সরকার।’’

 

ডাইসির (Dicey) মতে, ‘‘গণতন্ত্র হল সরকারের একটি রূপ যেখানে পরিচালনা পরিষদে সমগ্র জাতির একটি বড় অংশ অন্তর্ভুক্ত।’’

 

লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) তার ‘Modern Demoracies’ গ্রন্থে বলেছেন, “যেখানে শাসনব্যবস্থা কোন শ্রেণির উপর ন্যস্ত না থেকে সমগ্র সমাজের সদস্যদের উপর ন্যস্ত থাকে তাই গণতন্ত্র।”

 

জে. এস. মিলের মতে, “রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতায় সকলের প্রবেশাধিকার হচ্ছে গণতন্ত্র।”

 

অধ্যাপক সিলির (Prof. Selley) মতে, “গণতন্ত্র হলাে এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেকেরই অংশগ্রহণ রয়েছে।”

 

গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলী: গণতন্ত্র একটি আদর্শ শাসনব্যবস্থ । এখানে জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব এবং সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। তবে এর সফলতার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করা দরকার।যথা নিম্নরূপ;

 

(১) গণতান্ত্রিক জনগণ: জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, গণতন্ত্রের জন্য সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক চেতনা মানুষকে শাসনব্যবস্থায় অংশ নিতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করতে উৎসাহিত করে।

 

(২) গণতান্ত্রিক পরিবেশ: যে পরিবেশে মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে ও উন্নতি করতে পারে তাই গণতান্ত্রিক পরিবেশ। এজন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা জরুরী। বৈষম্য ও শোষণ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। তাই সকলের মাঝে সমতা ও ন্যায্য বণ্টন প্রয়োজন। সমাজতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।

 

(৩) গণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা: গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা জরুরি। এজন্য উৎপাদনের উপাদানগুলোর সামাজিক মালিকানা ও সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। এতে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সাম্যের পরিবেশ তৈরি হয়।

 

(৪) পরমতসহিষ্ণুতা: গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে, ফলে বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হয়। সব মতের প্রতি সহিষ্ণু হওয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

(৫) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: গণতন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়াতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। এতে জনগণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে। স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো এতে সহায়তা করে থাকে।

 

(৬) উপযুক্ত নেতৃত্ব: সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিবেকসম্পন্ন নেতৃত্ব গণতন্ত্রের ভিত্তি। নৈতিকতা ও বিচক্ষণতা ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ও পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে তাই গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন।

 

(৭) সৎ ও দক্ষ সরকারী কর্মচারী: গণতন্ত্র সফল করতে সৎ ও দক্ষ প্রশাসন প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিরা শাসনকার্য পরিচালনা করলেও দক্ষ কর্মচারীরা সেটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেন।

 

(৮) উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা: জনগণের শিক্ষা গণতন্ত্রের ভিত্তি। অশিক্ষিত জনগণ অনেক ক্ষেত্রে সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় ফলে শাসনব্যবস্থা অন্তঃসারশূন্য হয়ে যায়।

 

(৯) লিখিত সংবিধান: একটি লিখিত সংবিধান জনগণ ও সরকারের অধিকার ও কর্তব্য স্পষ্ট করে। এটি স্বৈরাচার রোধ করে গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখে।

 

(১০) রাজনৈতিক দল: গণতন্ত্রে একাধিক রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারকে স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাখতে বাধ্য করে।

 

(১১) গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য: গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জনগণকে গণতন্ত্র রক্ষায় সচেতন করে এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা গড়ে তোলে।

 

(১২) সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব: গণতন্ত্রে সকল জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। সংখ্যালঘুদের জন্যও প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে তারা সরকারী সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে।

 

(১৩) সামাজিক দায়িত্ববোধ: গণতন্ত্র সফল করতে জনগণের সামাজিক দায়িত্ববোধ জরুরি। জনগণকে সংকীর্ণ স্বার্থের বদলে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করতে হবে। সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার মানসিকতা বজায় রাখতে হবে।

 

(১৪) জাতীয় সংহতি ও ঐক্য: গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে জাতীয় ঐক্য দরকার। জাতিগত বিভাজন ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে সকলের মধ্যে ঐক্যের পরিবেশ গড়তে হবে।

 

(১৫) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ। সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন গণমাধ্যম না থাকলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়।

 

(১৬) জনমত: গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য আর একটি অপরিহার্য শর্ত হল সুস্থ, সবল ও সদাজাগ্রত জনমত। সদা সতর্ক ও সক্রিয় জনমত সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ করে এবং সরকারকে গণমুখী করে।

 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, কোন একক শর্ত পালনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের সাফল্য  অর্জন সম্ভব নয়। জনগণের সচেতনতা, স্বাধীনতা ও সমতার পরিবেশ নিশ্চিত করণ গণতন্ত্রের সফলতার পূর্ব শর্ত। বৈষম্য ও শোষণ রোধ, ন্যায্য বণ্টন, স্বচ্ছ নেতৃত্ব ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে টেকসই সফলতার দিকে নিয়ে যায়। বস্তুত: জনগণ ও শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথাযথ উপস্থিতি গণতন্ত্রের সফলতার মূল ভিত্তি। 

 

Links

Home

Exams

Live Exam

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD