চাকমা এথনিক গোষ্ঠীর জীবনধারা আলোচনা কর।

Shihabur Rahman
চাকমা
এথনিক গোষ্ঠীর জীবনধারা আলোচনা কর।
ভূমিকা: আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বহুমুখী সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।
চাকমা ও গারো এদেশের দুটি উল্লেখযোগ্য আদিবাসী
সম্প্রদায় যারা তাদের অনন্য সংস্কৃতি, রীতিনীতি, এবং জীবনধারার জন্য অধিক পরিচিত। চাকমারা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি,
খাগড়াছড়ি, এবং বান্দরবান জেলায় বসবাস করে।
পাহাড়ি এলাকায় তাদের বসবাসের কারণে তাদের জীবনধারা অনেকাংশে পাহাড়ের উপর
নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের
চাকমা উপজাতির আর্থ-সামাজিক জীবনধারা:
চাকমা হল বাংলাদেশে অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যে প্রগতিশীল উপজাতি।
চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে বাস করে। নিম্নে চাকমা উপজাতির আর্থ-সামাজিক বা সাংস্কৃতিক জীবনধারা
আলোচনা করা হলো-
(১)
চাকমা নামকরণ: বয়স্ক শিক্ষিত চাকমারা নিজেদের চাকমা
নামে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। নৃ-তাত্ত্বিক রিজলের মতে, ব্রম্ভাষার সাক বা
সেক জাতি থেকে চাকমা উপজাতির উৎপত্তি হয়েছে। ক্যাপ্টেন লুহন বলেন, "The name
chakma, probably has been given by the inhabitants of Chittagong."
(২)
উৎপত্তি ও ইতিহাস: মগদের মতে, চাকমারা
মুঘলদের বংশধর। এককালে মুঘলরা আরাকানের হাতে পরাজিত হলে আরাকান রাজ তাদের বন্দী করে
আরাকানী নারীদের সাথে বিবাহ দেন। এসব মুঘল সৈন্যের ঔরষে- আরাকানী নারীদের গর্ভে যে
জাতির উদ্ভব হয়েছিল তারাই সাক বা সেক। চাকমা পুরাকাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে, চাকমাদের
পূর্বপুরুষরা "চম্পক নগরে” বাস করতাে।
এটা সম্ভবত ভারত বা মিয়ানমারের কোনো অঞ্চলের অংশও ছিল। অতঃপর স্থানীয় দ্বারা বিতাড়িত
হয়ে চাকমারা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস শুরু করে।
(৩)
চাকমা জনসংখ্যা: বাংলাদেশে উপজাতিদের
মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে চাকমারা সর্বাধিক। চাকমাদের প্রায় ৩১ টি গোত্র রয়েছে।
১৯৯১ সালে করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায়, ৩,৪০,০০০ জন চাকমা বাস করে।
চাকমারা বাংলাদেশের মােট আদি উপজাতীয়দের প্রায় অর্ধেক। বর্তমান বাংলাদেশের চাকমাদের
সংখ্যা ৪,৮৩,৩৬৫।
(৪)
ভাষা: অন্যান্য উপজাতিদের থেকে চাকমাদের ভাষা
স্বতন্ত্র। চাকমারা তিব্বত-বর্মী ভাষায় কথা বলে। বর্তমানে তারা একটি উপভাষায় বাংলা কথা বলে, যাকে তারা চাকমা
বা চাঙমা বলে। তবে তাদের মধ্যে বাংলা ভাষাও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
(৫)
চাকমাদের ধর্ম: অধিকাংশ চাকমা
বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধধর্ম প্রধান হলেও চাকমাদের মধ্যে হিন্দুধর্ম, খ্রিস্ট ধর্মের
অনুসারী রয়েছে। গ্রাম্য এলাকায় বৌদ্ধ মন্দির দেখা যায়। তাদের মধ্যে দু'ধরনের বৈশিষ্ট্য
লক্ষ্য করা যায়। তারা গঙ্গা পুজা ও লক্ষী পূজা করে। গােজেন নামক ঈশ্বরকে তারা খুবই ভক্তিশ্রদ্ধা করে।
তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো ত্রিপিটক।
(৬)
চাকমাদের নরগােষ্ঠিগত পরিচয়: চাকমাদের
সাথে চীনা মঙ্গোলয়েডদের যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। তাদের উচ্চতা মাঝারি থেকে বেটে
আকৃতির। দৈহিক গড়নে এরা শক্তিশালী। গায়ে লােমের স্বল্পতা, চ্যাপ্টা নাক ও ক্ষুদ্র
চোখ লক্ষ্য করা যায়।
(৭)
চাকমা পরিবার: চাকমা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। চাকমা
পরিবারে সম্পত্তি বা বংশ পরিচয় পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়। চাকমারা সাধারণত এক বিবাহভিত্তিক
অনু পরিবার গঠন করে।
(৮)
বিবাহ প্রথা: বিবাহের ব্যাপারে চাকমা সমাজে কিছু
কুসংস্কার লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে নিজ বংশের সাত পরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ।
তাদের সমাজে অন্তঃবিবাহ ও বহিঃবিবাহ প্রচলিত। চাকমা সমাজে বহু স্ত্রী বিবাহ এবং বিধবা
বিবাহ অনুমােদিত।
(৯)
বিবাহ বিচ্ছেদ: চাকমা সমাজে বিবাহ
বিচ্ছেদ কদাচিৎ ঘটে। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য গ্রাম্য সালিশ ডাকতে হয়।
(১০) চাকমাদের পােশাক
পরিচ্ছদ: চাকমা পুরুষদের পােশাক হলাে ধুতি, কোট, কখনও মাথায় পাগড়ি। মেয়েরা সাধারণত
কোমর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্কার্ট, বুকে ব্রেস্ট ক্লোথ এবং মাথায় সাদা শিরস্ত্রাণ
পরিধান করে।
(১১)
চাকমাদের উৎসব: বিজু চাকমাদের
প্রধান উৎসব হলো বিজু উৎসব। এটি চাকমাদের নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক
উৎসব। এছাড়াও বুদ্ধ পূর্ণিমা, কথিন চীবর দান, মাঘি পূর্ণিমা চাকমাদের অন্যতম উৎসব। বিভিন্ন উদ্দেশ্যসাধনের জন্য
চাকমারা ঈশ্বরের পূজা করে থাকে।
(১২)
নেতৃত্ব: চাকমা সমাজে নেতৃত্ব মূলত রাজা, গাজী
(গজা), হেডম্যান ও কারবারি দ্বারা পরিচালিত হয়। চাকমা রাজা সর্বোচ্চ নেতা, যিনি বংশানুক্রমে
শাসন করেন। রাজাকে সহায়তা করেন গাজী (গজা), যারা বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেন।
হেডম্যান স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্ব দেন এবং কারবারিরা গ্রামের স্তরে বিরোধ মীমাংসা
ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রশাসনিক কাঠামো ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত এবং
এখনো বিদ্যমান।
(১৩)
শিক্ষা: অন্যান্য উপজাতির তুলনায় চাকমারা বেশি
শিক্ষিত। চাকমা সমাজে প্রাচীনকাল থেকে বৌদ্ধ বিহার ও মৌখিক শিক্ষা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে তারা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আধুনিক
শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকমা
শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ফলে আজকাল বহু চাকমা সরকারি উচ্চপদে নিয়ােজিত।
(১৪)
চাকমা অর্থনীতি: চাকমা অর্থনীতি
মূলত কৃষিনির্ভর, যেখানে ঝুম চাষ প্রধান ভূমিকা পালন করে। তারা ধান, ভুট্টা, শাকসবজি
ও ফলমূল উৎপাদন করে। মাছ ধরা, পশুপালন ও বনের সম্পদ সংগ্রহ চাকমাদের জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ
অংশ। আধুনিক সময়ে বাণিজ্য, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও চাকরির ক্ষেত্রেও তারা যুক্ত হয়েছে। এছাড়া,
বেত ও বাঁশজাত পণ্য তৈরিও চাকমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
(১৫)
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া: চাকমা
সমাজে মৃতদেহ পােড়ানাে হয়। তবে বুধবারে মৃতদেহ পােড়ানাে নিষিদ্ধ। সাত বছরের কম বয়সীদের
কবর দেয়া হয়। মৃত্যুর সাতদিন পর সাতদিন্যা নামক একটি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এ অনষ্ঠানে
মদ, খাদ্য প্রভৃতি দ্রব্য মৃতের আত্মার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, চাকমারা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও স্বতন্ত্র
জাতিগোষ্ঠী। তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি,(সঙ্গীত, নৃত্য) ও ঐতিহ্য তাদের পরিচয়ের
মূল ভিত্তি। তারা ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা বাংলাদেশের
জাতিগত বৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
3