বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বলতে কি বুঝ?

Avatar

Al Amin

Academic

বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বলতে কি বুঝ? তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ভূমিকা আলোচনা কর।


ভূমিকা: বুদ্ধিজীবী হলো এক শ্রেণীর মানুষ যারা জ্ঞান, শিক্ষা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখে। তারা মানুষকে নতুন এবং মুক্ত ভাবে চিন্তা করতে শিখায়। এই শ্রেণীর সদস্যরা সাধারণ মানুষের চেয়ে চিন্তা-চেতনায় অনেকটা অগ্রগামী এবং সুদূরপ্রসারী হয়। ঐতিহাসিকভাবে, লেখক, শিক্ষক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাংবাদিক এবং ধর্মীয় নেতাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। এই আলোচনায় আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের উপর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রভাব সম্পর্কে জানব।


তৃতীয় বিশ্বের দেশ: যে সকল দেশ স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে (১৯৪৭-১৯৯১) প্রধান দুটি সামরিক জোট, ন্যাটো (উত্তর আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) এবং ওয়ারশ প্যাক্ট (Warsaw Pact), এর কোনোটিতেই যোগদান করেনি তাদের কে তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরপরই স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ জোট গঠিত হয়।


আরো পড়ুনঃ ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণসমূহ


ন্যাটোর সহযোগী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন তথা পশ্চিম ইউরোপ; এদের বলা হয় প্রথম বিশ্ব। আর সোভিয়েতের পক্ষে থাকা চীন, কিউবা ও তাদের সহযোগীরা হলো দ্বিতীয় বিশ্ব। কোনো পক্ষে অংশ না নেওয়া আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া, ওশেনিয়ার দেশগুলি হলো তৃতীয় বিশ্ব।


তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের প্রতি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভূমিকা

ঔপনিবেশিক বিরোধিতা: একটি শক্তিশালি দেশ কর্তৃক জোর পূর্বক অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশকে শাসন এবং শোষণের নামই ঔপনিবেশিক শাসন। এই শাসন ব্যাবস্থায় শোষিত জনগোষ্ঠী তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। অত্যাচারী শাসকদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে তারা মানব সমাজ থেকে ছিটকে পরে।

যেমন ১৭৫৭-১৯৪৭ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ভারতবর্ষের জনগণ ছিল। আর এই ঔপনিবেশিক যুগে, বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।


আরো পড়ুনঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কী বোঝো


জাতীয় পরিচয় গঠন: মানুষ তাদের জাতীয় পরিচয় ছাড়া সমাজে বা বিশ্ব দরবারে বাঁচতে পারে না। একটি রাষ্ট্রে তার নাগরিকদের এই পরিচয় তৈরী করতে প্রয়োজন হয় একশ্রেণীর সুশিক্ষিত এবং সুদূর চিন্তাশীল মানুষের। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর, বুদ্ধিজীবীরা আমাদের জাতীয় পরিচয় গঠনে এবং নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।


সামাজিক ন্যায়বিচার: সমাজ সর্বদা উচ্চবিত্ত শ্রেণী কর্তৃক শাষিত হয়। এখানে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ সামাজিক ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তুলেছেন। সর্বোপরি তারা সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।


সাংস্কৃতিক উন্নয়ন: একটি জাতির জীবনে সংঘটিত প্রত্যেকটি কার্যক্রমই তাদের সংকৃতির অংশ।  কিন্তু সুশিক্ষিত জনগণ ছাড়া এই সংস্কৃতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাছাড়া, অপসংকৃতি নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনাও থাকে।বুদ্ধিজীবীরা সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র সমূহের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতির সমৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন।


গণতন্ত্র: গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শাসকগোষ্ঠী জনগণের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে তাদের উপর অপশাসন চালায়।বুদ্ধিজীবীরা গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের পক্ষে কণ্ঠস্বর তুলেছেন।


অর্থনৈতিক উন্নয়ন: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বেশিরভাগই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এর উপর নির্ভরশীল। শিল্পায়ন এখানে তেমন নেই। তাই এখানকার মানুষেরাও খুব একটা উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ পায় না। বুদ্ধিজীবীরা নানা সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন মুখী পরিকল্পনা পরিচয় করানোর মাদ্ধমে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনে অংশগ্রহণ করে। 


আরো পড়ুনঃ নির্বাচক মন্ডলীর সংজ্ঞা দাও


দারিদ্র্য ও অসমতা বিমোচন: তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাব দেশগুলোতে দারিদ্র্য ও অসমতা ব্যাপক আকারে লক্ষ্য করা যায়। বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মানুষেরা এই অসমতা বিমোচনে সরকার সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ প্রদান করে থাকে।


শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন: শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান এই দেশগুলোতে খুবই নিম্নমানের। এসকল দেশে এই শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষেরা সাধারণ জনগনকে তাদের স্বাস্থ সম্পর্কে সচেতন হতে সযযোগিতা করে। 


রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন: অনেক তৃতীয় বিশ্বের দেশে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা বিরাজমান করে। বুদ্ধিজীবী শ্রেণী মানুষের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। 


বিবিধ: বুদ্ধিজীবীরা উচ্চশিক্ষিত এবং জ্ঞানী জাতি গঠনে কাজ করে। তারা মানুষকে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার ক্ষমতা গঠনে কাজ করে। তারা তাদের কার্যক্রমের মাদ্ধমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং নতুন ধারণার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। মানুষকে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ শেখাতেও তারা কাজ করে।

 

উপসংহার: "তৃতীয় বিশ্ব" প্রত্যয়টি সমালোচিত। কারণ এটি মানব সমাজে নেতিবাচক ধারণা তৈরী করে।  তাই বর্তমানে এর পরিবর্তে "উন্নয়নশীল দেশ" প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এসকল দেশের নাম পরিচয় এর যা পরিবর্তনই হোক না কেন এদের অর্থনৈতিক অবস্থা একই রকম। এই দেশগুলোতে তাই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভূমিকা সবসময়ই বিদ্যমান। এই সম্প্রদায়ের মানুষের প্রভাবে দিন দিন তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং ধর্মীয় ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। 

Get Our App

Download our app for a better experience.

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD