বন শূন্যতার কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।
ভূমিকা: সরল ভাষায়, বনভূমি কৃষিকাজ, শিল্প বা শহুরে ব্যবহারের জন্য বন বা গাছ কাটা এবং সাফ করাকে বোঝায়। এর মধ্যে রয়েছে জমি আবাসিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প উদ্দেশ্যে উপযুক্ত করার জন্য বনাঞ্চলের স্থায়ীভাবে সমাপ্তি। বিগত শতাব্দীতে, বিশ্বজুড়ে বনাঞ্চল উল্লেখযোগ্যভাবে আপস করা হয়েছে, সবুজ কভারটি সর্বকালের সর্বনিম্ন প্রায় ৩০ শতাংশে নেমে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, প্রতি বছর আনুমানিক ১৮ মিলিয়ন একর বন ধ্বংস হয়।
বন শূন্যতার কারণ সমূহ
বন শূন্যতার জন্য বিভিন্ন কারন চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারনগুলো দেওয়া হলো।
প্রাকৃতিক কারণ
১. দাবানল: প্রাকৃতিক কারনেই হোক বা মানুষের দাঁড়ায় হোক বনভূমিতে আগুন লাগলে বনভূমি ধ্বংস হয়। সাধারণত বজ্রপাত এবং গাছে গাছে ঘর্ষনের ফলে দাবানলের সৃষ্টি হয়। ফলে বিস্তৃর্ন অঞ্চলের বনভূমি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
যেমন – অস্ত্রেলিয়ায় দাবানলে প্রচুর বনভূমি প্রতি বছর দাবানলের কারণে নষ্ট হয়।
আরো পড়ুনঃ কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী
২. ভূমিকম্প: প্রবল তীব্রতার ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় বিশাল আকারের ভূমিভাগের অবনমন ঘটলে তার উপরের সব গাছপালা মাটির নিচে চাপা পড়ে অরণ্য ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
৩. অগ্ন্যুৎপাত: কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত ঘটলে যে উত্তপ্ত লাভা স্রোত নির্গত হয়, তা যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেখানকার উদ্ভিদকে দগ্ধ করে দেয়।
৪. অ্যাসিড বৃষ্টি: কয়লা ও খনিজ তেলের দহনের ফলে এবং তাপবিদ্যুৎ ও ধাতু নিষ্কাশন কেন্দ্র থেকে নির্গত নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিড বৃষ্টির জলের সাথে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি রূপে পৃথিবীপৃষ্টে পতিত হ্য,যার ফলে অরন্যের বহু উদ্ভিদ বিনষ্ট হয়।
৫. ধস: পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়শই ভূমিধস দেখা যায়, যার ফলে অরণ্য বিনষ্ট হয়।
৬. কীট পতঙ্গের আক্রমন: বনভূমির মধ্যে বিশেষ কিছু প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে কীটপতঙ্গের আক্রমন যথেষ্ট মাত্রায় দেখা যায়। ফলে কোথাও কোথাও বিস্তৃর্ন অঞ্চলে বনভূমি ধ্বংস হয়।
অর্থনৈতিক কারণ
১. বহুমুখী নদী পরিকল্পনা: বহুমুখী নদী পরিকল্পনা বনভূমি ধ্বংসের আরেকটি অন্যতম কারণ। প্রধানত কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদী তে বাঁধ দিয়ে বাঁধের পশ্চাতে জল ধরে রাখা হয়, এর ফলে বাঁধের পশ্চাতে বিস্তৃত অঞ্চল জলমগ্ন হয়। ফলে ওই অঞ্চলের বনভূমি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
২. বনভূমি পশুচারন ভূমিতে রূপান্তর: জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যেমন খাদ্যশস্যের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি দুদ্ধজাত দ্রব্য, মাংস ও চামড়ার প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে বহুগুন। ফলে পশুচারন ক্ষেত্রের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বনভূমি সংকুচিত হয়।
৩. বনভূমি কৃষিভূমিতে রূপান্তর: ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে বনভূমি দ্রুত পরিষ্কার করে চাষের জমিতে পরিনত করা হচ্ছে। এর ফলে বনভূমি ধ্বংস পাপ্ত হচ্ছে। এই কারণ গুলির জন্য উন্নয়নশীল দেশ গুলিতে খুব দ্রুত অরন্যের বিনাশ ঘটছে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে সমাজকর্মের বৈশিষ্ট
৪. স্থানান্তর কৃষি বা ঝুম চাষ: দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রাম্যমান উপজাতিদের জঙ্গল পুড়িয়ে আদিম প্রথায় চাষ আবাদ করার ফলে বনভূমির দ্রুত বিলাপ ঘটছে। এদিক থেকে ওড়িশা অগ্রনি ভূমিকা গ্রহন করে।
৬. শিল্পস্থাপন: উন্নত দেশগুলিতে শিল্প ব্যবস্থা দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন শিল্পকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা, যার ফলে বৃক্ষচ্ছেদন করার প্রবনতা দেখা যায়।
৭. যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারন: যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারনের জন্য নতুন রাস্তা ও রেলপথ নির্মানের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। এই রাস্তা ও রেলপথ নির্মানের জন্য যে জায়গার দরকার হয়, তার জন্য গাছপালা ও বনভূমি কাটা হয়, ফলে অরন্যের বিনাশ ঘটে। বর্তমানেও আমাদের দেশে সড়ক পথ নির্মানের জন্য প্রচুর গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে।
৮. খনি উত্তোলন ক্ষেত্রে: বনভূমি অঞ্চলে কোন নতুন খনি আবিষ্কার হলে, সেখানে খনি উত্তোলন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য নির্বিচারে প্রচুর পরিমানে বৃক্ষ কেটে ফেলা দেওয়া হয়, যার ফলে প্রচুর বনভূমি হ্রাস হয়।
সামাজিক কারণ
১. বসতি স্থাপন: প্রতিবছর সারা বিশ্বব্যাপী প্রচুর পরিমানে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই বিপুল পরিমান জনসংখ্যার বসত বাড়ি নির্মান ও তাদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বনভূমি কেটে বসত বাড়ি নির্মান ও কৃষিজমি তৈরি করা হচ্ছে। যা বর্তমানে বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ।
২. বেআইনি ভাবে বৃক্ষচ্ছেদন: বিশ্বের অনেক দেশে কাঠের চোরাচালানের ব্যবসা আছে। এই ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সরকারী বিধিনিষেদ না মেনে বেআইনি ভাবে গাছ কেটে চলেছে। এই ভাবে গাছ কাঁটার ফলে ব্রাজিলের আলাজন অরন্যের পরিমান অনেকটাই কমে গেছে।
বন শূন্যতার ফলাফল
বন উজাড় জলবায়ু পরিবর্তন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। একই সাথে বন্যা বন্যজীবন ধ্বংস, মানুষের নিম্নমানের জীবনমান, মহাসাগরের অম্লতা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্রমশ ক্ষয় ঘটায়।
১. ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস: গাছপালার শিকড় মাটিকে শক্তভাবে ধরে রাখে। পক্ষান্তরে বৃক্ষহীন মাটি আলগা থাকায় বৃষ্টির মাধ্যমে সহজে ধুয়ে যেতে পারে। অনেক সময় ভূমিধসও ঘটতে পারে।
২. নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস ও প্লাবন সৃষ্টি: ভূমিক্ষয় ও ভূমিধসের ফলে উজান থেকে নেমে আসা মাটি, বালু বা পাথরের টুকরা ভাটির নদ-নদীর তলদেশে জমা হলে নাব্যতা হ্রাস পায়, নদীর গভীরতা কমে যায় এবং পানি ধারণ ক্ষমতাও সংকুচিত হওয়ায় বন্যা বা প্লাবন দেখা দিতে পারে।
৩. জমির উর্বরতা হ্রাস: বনভূমি সংকুচিত হলে জ্বালানি কাঠের সংকট সৃষ্টি হবে। ফলে গবাদিপশুর গোবর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় জমিতে জৈবসারের যোগান হ্রাস পাবে। এতে জমির উর্বরতা কমবে।
আরো পড়ুনঃ সমাজসেবা কাকে বলে? সমাজসেবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
৪. গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া: বনজঙ্গল ধ্বংসের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবে যা গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটবে এবং মেরু এলাকার বরফ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে অনেক নিচু এলাকা তলিয়ে যাবে।
৫. আবহাওয়া পরিবর্তন: পানি সংরক্ষণ ও বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বৃক্ষের একটি সম্পর্ক আছে। বৃক্ষ কেবল বৃষ্টিপাত বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়, মাটিতে বৃষ্টির পানি ধারণেও সক্ষম। বনভূমি ধ্বংসের ফলে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও বায়ুপ্রবাহের আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
৬. মরুকরণ: উদ্ভিদরাজি বিনাশের ফলে কোন অঞ্চলের স্থানীয় আবহাওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ভূমির জৈবিক ক্ষমতা বিনষ্ট হলে উদ্ভিদ শূন্যতার কারণে মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়।
৭. বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি: বন্যপ্রাণীর প্রধান আবাসস্থল বন-জঙ্গল। প্রয়োজনীয় বনভূমির অভাবে বন্যজীবের বসতি, প্রজনন ক্ষেত্র এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হতে থাকে।
৮. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বনভূমি ধ্বংসের ফলে উপকূলীয় ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে।
৯. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস: বনভূমি ধ্বংসের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ে। কারণ বনভূমি সংকোচনের কারণে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসতিও ধ্বংস হয়ে যায়।
১০. মূল্যবান বনজসম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়া: বনভূমি ধ্বংসের ফলে মূল্যবান গুঁড়ি কাঠ, মধু, ফলমূল, ওষুধ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি থেকে আমরা বঞ্চিত হব।
উপসংহার: বন শূন্যতা একটি বড় পরিবেশগত সমস্যা। এর ফলে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বন শূন্যতা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করছে। তাই বন শূন্যতা রোধে সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।