বেকারত্ব কি? বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণের উপায় সমূহ বর্ণনা কর।
ভূমিকা: বেকারত্ব একটি সমাজের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল সমস্যা। এটি ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক, এবং মানসিক জীবনকে প্রভাবিত করে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেকারত্ব সমস্যা আরও বেশি প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত বিপুলসংখ্যক মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু তাদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বেকারত্ব কী:
বেকারত্ব বলতে এমন একটি অবস্থাকে বোঝানো হয়, যখন কাজ করতে সক্ষম ব্যক্তি কাজ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। বিশেষত, একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে যদি কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দেয় এবং কাজের চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ তৈরি না হয়, তখন সেটি বেকারত্ব হিসেবে গণ্য হয়।
বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়সমূহ:
১. জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ:
বাংলাদেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে বেকারত্বের হার বাড়ছে। এজন্য প্রথমত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আরো পড়ুনঃ সমাজ সংস্কার কাকে বলে?
২. শিল্পায়ন বৃদ্ধি:
দেশে দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা এবং ছোট-মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
৩. শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার:
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কাজের বাজারের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় তাত্ত্বিক শিক্ষার পরিবর্তে বাস্তবমুখী এবং প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা প্রবর্তন করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলবে এবং তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে।
৪. কারিগরি শিক্ষার প্রসার:
কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো গেলে দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে এবং তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারের জন্য আরও যোগ্য হয়ে ওঠে।
৫. বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি:
বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি বেকারত্ব কমানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। সঠিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরির সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে।
৬. কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি:
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, তাই কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা গেলে গ্রামীণ বেকারত্ব অনেকাংশে হ্রাস পাবে। কৃষিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব।
আরো পড়ুনঃ মানব ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
৭. স্ব-উদ্যোক্তা ও ছোট ব্যবসার প্রসার:
স্ব-উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে মানুষের উৎসাহ প্রদান করে বেকারত্ব কমানো যেতে পারে। সরকারকে ক্ষুদ্র ঋণ, প্রশিক্ষণ, এবং সহায়তা প্রদান করতে হবে যাতে মানুষ নিজের কাজ শুরু করতে পারে এবং অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
৮. নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান:
বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই কর্মবাজারের বাইরে রয়ে গেছে। নারীদের ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে নারীরাও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এবং বেকারত্ব হ্রাস পাবে।
৯. সরকারি চাকরির শূন্য পদ পূরণ:
বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক শূন্যপদ রয়েছে, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে পূরণ করা হচ্ছে না। এই শূন্যপদ পূরণ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে, যা বেকারত্বের হার কমাবে।
১০. বেসরকারি খাতের উন্নয়ন:
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এবং কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বেসরকারি খাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং নতুন উদ্যোগের প্রসারে সরকারি সহায়তা দেওয়া গেলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
১১. কুটির শিল্পের প্রসার:
গ্রামীণ এলাকায় কুটির শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থান তৈরি করা যেতে পারে। এই ধরনের শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে বেকারত্ব কমবে এবং দেশের আর্থিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।
১২. উন্নত প্রশিক্ষণ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা:
শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা কর্মসংস্থানের উপযোগী হয়ে উঠবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
আরো পড়ুনঃ দারিদ্র্যের কারণ
উপসংহার: বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান বাধা। তাই এই সমস্যার সমাধানের জন্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং বেকারত্বের হার কমানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা জরুরি। বেকারত্ব দূরীকরণে সফল হলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।