বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি মূল্যায়ন কর।
ভূমিকা: রাজনীতি জীবনের মতই নিরন্তন প্রবহমান। এ প্রবহমান ধারার মাঝেই আমাদের সমাজের গতিপ্রকৃতি, স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য নিবিড়ভাবে জড়িত। জীবনের আর সব প্রত্যয়ের মত রাজনীতির রয়েছে নিজস্ব পরিসর, পরিবেশ, চারণভূমি। এককথায়, রাজনীতির রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এ ভাষা কখনও সরব, কখনও নীরব, কখনও রাজপথে উচ্চকিত স্লোগানে, কখনও একান্ত নীরবে গোপনে দেয়ালে দেয়ালে। আবার কখনও গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রে। আর এসব নিয়েই গড়ে ওঠে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। তাই জাতীয় চরিত্র, জাতীয় মনোভাব ইত্যাদি ভাবকে ধারণ করার জন্য মূলত রাজনৈতিক সংস্কৃতি কথাটি ব্যবহৃত হয়। একটি দেশে কোনো এক ধরনের শাসনব্যবস্থা সফল হচ্ছে, অন্য দেশে তা হচ্ছে না। এ বিষয়টি কি রাজনৈতিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে না, জাতীয় চরিত্রের উপর নির্ভর করে এ প্রশ্ন থেকেই রাজনীতিতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অধ্যয়নের সূত্রপাত হয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে যাদের নাম বিশেষভাবে জড়িত তারা হলেন অ্যালমন্ড (Almond), ওলাম (Ulam), বিয়ার (Beer) ও ভার্বা (Verba) প্রমুখ। রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব, গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত হতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে পড়ে। এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যাপক বিষয় নিয়ে আলোচিত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি প্রসঙ্গে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ধর্ম ও সংস্কৃতি: বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ এবং এদেশে সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে। মানুষের জীবনাচরণের প্রতিটি পর্যায়ে ধর্মের স্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। মানুষ ধর্মের বাইরে কোনো কাজ করে না। সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম মানুষকে বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দান করেছে। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান। এদেশে সলামভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যদিও রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ইসলাম ধর্মের প্রভাব কম।
২. পরিবারতন্ত্র: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবারতন্ত্রের একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। এদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে এসেছেন। আবার বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রীও পারিবারিক সূত্রেই রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছেন।
৩. একনায়ক: বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও এখানে যারা শাসক হয়ে আসেন, তারা একনায়কত্ব কায়েম করেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সকল রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করেন। এভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একনায়কত্বের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস আলোচনা কর।
৪. গ্রামীণ সংস্কৃতি: বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে গ্রামের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। গ্রামের মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতির বৃহত্তর অংশ। কিন্তু গ্রামের মানুষের রাজনীতিতে সচেতনতা অনেক কম। তারা রাজনীতির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাতে পারে না আবার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাত্রাও কম। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে Marginal culture ও বলা হয়।
৫. রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি বেশি মাত্রায় বিদ্যমান। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনীতির প্রায় সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
৬. রাজনৈতিক দল ও সংগঠন: বাংলাদেশের জনগণ স্থানভেদে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সাথে যুক্ত। গ্রাম ও শহরের জনগণ নিজস্ব পরিসরে সংগঠন গড়ে তোলে এবং সংগঠনের পক্ষে কাজ করে। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সংগঠনভিত্তিক রাজনীতি পরিচালিত হয়।
৭. নারীর অংশগ্রহণ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়। তবে এদেশের নারীরা এখনো পুরোপুরি রাজনীতি সচেতন হয়ে গড়ে ওঠেনি বা রাজনীতিতে এখনো তারা বলিষ্ঠ অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ আরও কম।
আরো পড়ুনঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নেতিবাচক দিক
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি মূলত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তির মনোভাব ও মূল্যবোধ, যা আধুনিক রাজনীতি বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর এ রাজনৈতিক সংস্কৃতির গঠন, সংরক্ষণ ও সঞ্চালনের প্রক্রিয়াই হলো সামাজিকীকরণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করলে বুঝা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পরিবারকেন্দ্রিক একনায়ক এবং সংখ্যাধিক।