বাংলা নামের উৎপত্তি

Avatar

Al Amin

Academic

বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে কী জান?


ভূমিকা: বাংলাদেশের নামকরণের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং এর পেছনে রয়েছে বিভিন্ন মতামত এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উৎপত্তি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় বরং দীর্ঘদিনের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক পরম্পরার অংশ। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘বঙ্গ’ বা ‘গৌড়,’ যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে ‘বাংলা’ নামে পরিচিত হয়। এই নামের উৎপত্তি ও তার পিছনের কারণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত যে, ‘বাংলা’ নামটি বাঙালির অস্তিত্বের পরিচায়ক।


বাংলা নামের উৎপত্তি:


বাংলা নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক মতামত রয়েছে। নিম্নে এই মতগুলো আলোচনা করা হলো:


১. পৌরাণিক কাহিনী: পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত আছে যে, অন্ধ মুনির গর্ভে পাঁচজন সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তার মধ্যে একজন ছিলেন রাজা বঙ্গ। তিনি ছিলেন এক পরাক্রমশালী শাসক এবং তার বংশধরদের থেকেই ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি। পরবর্তীকালে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘বাংলা’ নামে পরিচিত হয়। মুসলিম ঐতিহাসিক রিয়াজ উস সালাতিনের মতে, হযরত নূহ (আ)-এর এক বংশধর ছিলেন রাজা বঙ্গ, তার নাম থেকেই ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি হয়। এটি একটি পৌরাণিক কাহিনী হলেও এটি বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কিত একটি প্রচলিত ধারণা।


২. চীনা ও তিব্বতি শব্দের মিল: কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, ‘বঙ্গ’ নামটি চীনা ও তিব্বতি শব্দের সাথে সম্পর্কিত। ‘বঙ্গ’ শব্দের ‘অং’ অংশটি বিভিন্ন নদীর নামের সাথে মিল রয়েছে, যেমন গঙ্গা, হোয়াংহো, ইয়াংসিকিয়াং ইত্যাদি। বঙ্গ অঞ্চল নদীমাতৃক হওয়ায় ধারণা করা হয় এ কারণেই এ অঞ্চলের নাম ‘বঙ্গ’ হয়েছে। বিশিষ্ট পন্ডিত সুকুমার সেনের মতে, বঙ্গ নামের একটি অর্থ হলো কার্পাস তুলা, যা এ অঞ্চলে প্রচুর উৎপাদিত হত। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ব্যবসায়ীদের বর্ণনায় এ অঞ্চলের সুতি কাপড়ের প্রসিদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা সম্ভবত এই নামের উৎপত্তিতে প্রভাব ফেলেছে।


আরো পড়ুনঃ সমাজ বিজ্ঞান পরিচিতি বিগত সালের প্রশ্ন


৩. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ‘বঙ্গ’ অঞ্চলের সুতি বস্ত্রের কথা উল্লেখ রয়েছে। সুকুমার সেনের মতকে সমর্থন করে এই গ্রন্থটি প্রমাণ করে যে, এ অঞ্চল ছিল কার্পাস তুলা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এ কারণেই ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি হতে পারে।


৪. আবুল ফজলের মতামত: মোগল আমলের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে ‘বাংলা’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন যে, ‘বঙ্গ’ শব্দের সাথে ‘আল’ যোগ করে ‘বঙ্গাল’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, যা পরবর্তীতে পরিমার্জিত হয়ে ‘বাংলা’ হয়েছে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে ‘আল’ শব্দটির অর্থ হিসেবে সেমিট্রিক ভাষায় ‘সন্তান বা বংশধর’ বোঝানো হয়, যা ‘বঙ্গ’ অঞ্চলের বংশধর হিসেবে এই অঞ্চলের মানুষকে নির্দেশ করে।


৫. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মত: বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘বঙ্গ’ এবং ‘বাঙাল’ প্রাচীনকালে দুটি পৃথক অঞ্চল ছিল। ‘বাঙাল’ অঞ্চল থেকে ‘বাংলা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে। রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, প্রাচীন বাঙাল অঞ্চলের নাম থেকে বর্তমানের ‘বাংলাদেশ’ নামের উৎপত্তি হয়েছে। বাঙালি জাতি এই অঞ্চলের নাম থেকে তাদের জাতিগত পরিচয় পেয়েছে।


৬. আব্দুল মমিন চৌধুরীর মতামত: অধ্যাপক আব্দুল মমিন চৌধুরী মনে করেন, বঙ্গ অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বের কিছু জনপদ ‘বাঙাল’ নামে পরিচিত ছিল। তার মতে, নদীমাতৃক এ অঞ্চলে আল নির্মাণ করে কৃষিকাজ চালানো হত, যা ‘বঙ্গ’ শব্দের সাথে ‘আল’ যোগ করে ‘বাঙ্গাল’ নামের উৎপত্তি করে। ‘বাঙ্গাল’ থেকেই ‘বাংলা’ নামের উদ্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়াও নীহার গুঞ্জন রায় ও আব্দুল মমিন চৌধুরীও এই মত সমর্থন করেন।


আরো পড়ুনঃ ৬ দফা আন্দোলন কি? 


উপসংহার: অতএব, বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক মত প্রচলিতরয়েছে। তবে সবকিছুর মূলে দাঁড়িয়ে আছে ‘বঙ্গ’ নামের প্রাচীন ব্যবহার এবং তার থেকেই ‘বাংলা’ নামের বিকাশ। বাঙালির জাতিগত পরিচয়ের সাথে এই নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ‘বঙ্গ’ অঞ্চল প্রাচীনকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল, যা ধীরে ধীরে ‘বাংলা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

Get Our App

Download our app for a better experience.

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD