বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশধারা আলোচনা কর।

Shihabur Rahman
জাতীয়তাবাদ
কী? বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশধারা আলোচনা কর।
অথবা,
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের পটভূমি আলোচনা কর। অথবা, বাংলাদেশ সৃষ্টির ঐতিহাসিক পটভূমি
আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ জাতীয়তাবাদ হলো এমন একটি চেতনা বা আদর্শ যা একটি জাতির সামাজিক,
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক, স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে। এটি মানুষকে
ঐক্যবদ্ধ করে এবং একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার রূপদান করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলো এমন
একটি চেতনাগত ধারা, যা বাঙালি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বাধীনতার
দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকেই বাঙালি
জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে এর
চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ।
বাঙালি
জাতীয়তাবাদের বিকাশধারা
১.
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ: প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলার জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে নিজেদের স্বতন্ত্র
সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তোলে। বাংলা ভাষার বিকাশ, সাহিত্য, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কৃষিনির্ভর
অর্থনীতি বাঙালিদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ধারণা তৈরি করে।
২.
মুসলিম শাসন ও বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা: ১৩শ
শতকে মুসলিম শাসনের শুরু হলেও বাংলার সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে।
বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ বাংলা ভাষা ব্যবহারকে উৎসাহিত করেন। এই সময়ে বাংলার নিজস্ব
সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
৩.
মুঘল আমলে বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান: মুঘল শাসনকালে বাংলা অর্থনৈতিকভাবে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। বাংলার
জনগণ কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পে উন্নতি লাভ করলেও রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে
ছিল। এই সময় থেকেই বাঙালির মধ্যে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের চেতনা ধীরে ধীরে বাড়তে
থাকে।
৪.
ব্রিটিশ শাসন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা: ব্রিটিশ শাসনের ফলে বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ বৃদ্ধি
পায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নানা বিদ্রোহ যেমন সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭) এবং ফকির-সন্ন্যাসী
বিদ্রোহ ঘটে। এসব বিদ্রোহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে।
৫.
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫): ব্রিটিশরা
১৯০৫ সালে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করলে ক্রমান্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তীব্র তীব্র হয়ে
ওঠে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাঙালির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। কলকাতার হিন্দু
সম্প্রদায়ের বিরোধিতার কারণে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।
৬.
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির ভূমিকা: ভারতের
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু,
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বাঙালি নেতা জাতীয়তাবাদের পক্ষে
সংগ্রাম করেন।
৭.
পাকিস্তানের সৃষ্টি ও বাঙালির বঞ্চনা: ১৯৪৭
সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত
হতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা, অর্থনৈতিক শোষণ, প্রশাসনিক বৈষম্য ইত্যাদি কারণে বাঙালির মধ্যে
পাকিস্তানের প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে পায়।
৮.
ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২): পাকিস্তান
সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করলে বাঙালিরা প্রতিবাদ করে। ১৯৫২ সালের
২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহিদ হন। এই
আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি দৃঢ় করে।
৯.
ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬): বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, যা মূলত বাঙালির রাজনৈতিক
ও অর্থনৈতিক মুক্তির দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এই ছয় দফা আন্দোলনের ফলে জাতীয়তাবাদ
আরও শক্তিশালী হয়।
১০.
গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯): আইয়ুব
খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, যেখানে ছাত্র-জনতা
সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করে।
১১.
১৯৭০ সালের নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিজয়: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে
আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে
গড়িমসি করলে বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা আরও প্রবল হয়ে ওঠে।
১২.
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব: এই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির নেতা হিসেবে জনগণ
গ্রহণ করে। তিনি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতীক হয়ে ওঠেন।
১৩.
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭১
সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ চালালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত রূপ লাভ
করে এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১৪.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদের বাস্তবায়ন: স্বাধীনতার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শনের
ভিত্তি হয়ে ওঠে। সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত
করা হয়।
১৫.
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বর্তমান অবস্থা: বর্তমানে
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের ধারণা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। বৈশ্বিক প্রভাব, প্রযুক্তি,
রাজনৈতিক বিভাজন প্রভৃতি কারণে জাতীয়তাবাদের চেতনা নতুন মাত্রা লাভ করছে।
১৬.
ভবিষ্যতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা: আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে টিকিয়ে রাখা
চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তবে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নতুনভাবে
বিকশিত হতে পারে।
উপসংহার: বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু একটি রাজনৈতিক ধারণা নয়, এটি একটি
আবেগ, সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রতীক। এটি ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা
অর্জনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। ভবিষ্যতে এই জাতীয়তাবাদকে টিকিয়ে রাখতে হলে
আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
3