বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দাও।

Avatar

Shihabur Rahman

Academic

বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দাও। 

অথবা, বাংলাদেশের মানুষের জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় দাও। [NU- 2015, 17, 19, 21] ★★★

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী একটি সংকর বা মিশ্র জাতিগোষ্ঠী। ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, বহিরাগত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা গঠিত হয়েছে। নৃতাত্ত্বিক গবেষকদের মতে, বাঙালি জাতির শরীরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বাঙ্গালীদের শারীরিক গঠন, ভাষা, সংস্কৃতি, এবং সামাজিক বৈচিত্র্যের মাঝে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নানা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।

 

বাঙালি জাতির উদ্ভব: জীবাশ্মবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা কম হওয়ায় বাংলাদেশে বসবাসকারী মানুষের প্রাক-ইতিহাস যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ দ্বারা সমৃদ্ধ নয়। তবে ধারণা করা হয়, পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসা অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর লোকজন এ অঞ্চলে প্রথম মানব বসতি স্থাপিত করে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বাংলায় দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোল, শক, সেন, বর্মণ, তুর্কি, পাঠান, ইরানি, আরবীয়, আবিসিনীয়, ইংরেজ, পর্তুগিজ, মগ, ওলন্দাজ, আলপাইন প্রভৃতি ধারার মানুষদের আগমন ঘটে। এসব নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙ্গালীরা একটি সংকর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। অনেকের মতে, সংকর জনগোষ্ঠী হওয়া সত্তেও বাঙ্গালীদের দেহবৈশিষ্ট্যে আদি অস্ট্রেলীয় বা অস্ট্রিক তথা ভেড্ডিড জনগোষ্ঠীর দৈহিক বৈশিষ্ট্য অধিক পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়।

 

বাঙালি নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য: বাঙালি নরগোষ্ঠী বলতে যাদের মাতৃভাষা বাংলা এমন এক জনসমষ্টিকে বুঝায়। তবে বাংলাদেশ আগে কোন নরগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল কিনা, তা জানা সম্ভব হয় নি। মানবজীবাশ্ম সম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের ঘাটতি থাকার কারণে বাংলাদেশের মানুষের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য।

 

বাঙালি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ঃ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক মনীষীদের মতে, বাঙালির দেহে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রভাব বিদ্যমান। স্বীকৃত মতামত অনুসারে এ অঞ্চলে আদি মানুষের বসবাস ছিল না। ফলে এখানে একসময় বহিরাগতরা বসতি স্থাপন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংমিশ্রণের ফলে বাঙালিরা একটি মিশ্র বা সংকর জনগোষ্ঠীতে  পরিণত হয়।

 

স্যার হার্বার্ট রিজলের মতে, ভারতীয় উপমহাদেশের জনসমষ্টি সাতটি ভাগে বিভক্ত।  এগুলো হচ্ছে: ১. তুর্কীয়-ইরানীয়  ২. ভারতীয় আর্য ৩. শক-দ্রাবিড়  ৪. আর্য-দ্রাবিড় ৫. মঙ্গোল-দ্রাবিড়  ৬. মঙ্গোলীয় এবং ৭. দ্রাবিড়ীয়

 

তাঁর মতে বাঙালিরা মঙ্গোল-দ্রাবিড়-প্রভাবিত একটা সংকর জনগোষ্ঠী। এর কারণ হিসেবে তিনি বাঙালিদের শ্যামলা ও পীত গায়ের রং, চওড়া (গোল) মাথা, মধ্যমাকৃতি থেকে চওড়া নাক এবং মাঝারি উচ্চতাকে মঙ্গোলীয় প্রভাব হিসেবে অভিহিত করেন। অন্যদিকে, বাদামি-কালো গায়ের রং, লম্বা মাথা, চওড়া নাক, চোখের রং ও গঠন, মুখে দাড়ি-গোঁফের আধিক্য দ্রাবিড়-জাতি গোষ্ঠীর প্রভাব বলে উল্লেখ করেন।

 

জে. হুটন ভারতীয় উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে মোট আটটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো:

১. নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটু ২. আদি-অস্ট্রেলীয় ৩. আদি-মেডিটেরিয়ান ৪. সভ্য-মেডিটেরিয়ান ৫. আর্মানীয়, ৬. আলপাইন ৭. বৈদিক-আর্য এবং ৮. মঙ্গোলীয়।  

 

পন্ডিত বিরজাসংকর গুহ ভারত উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে ছয়টি নৃতাত্তিক ধারায় ভাগ করেছেন। এগুলো হল: ১. নিগ্রোবটু ২. আদি অস্ট্রেলীয় ৩. মঙ্গোলীয় ; ৪. মেডিটেরিয়ান ৫. আলপো-দিনারীয় এবং ৬. নর্ডিক

 

নৃতত্তবিদ ভন আইকস্টেড্ট ভারতীয় উপমহাদেশের মানবগোষ্ঠীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন। এগুলো হল: ১. ভেড্ডিড-প্রাচিন অধিবাসী; ২. মেলানীড-কৃষ্ণকায় অধিবাসী এবং ৩. ইন্ডিড-আধুনিক অধিবাসী।

 

ভারতীয় পন্ডিত রমাপ্রসাদ চন্দ মনে করেন যে, বাঙালিরা বৈদিক-আর্যভাষি জাতিসমূহ দ্বারা প্রভাবিত। বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে (আদিপর্ব) নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন, বাঙালির নৃগোষ্ঠী গঠনে আদি অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় প্রভাবের পাশাপাশি আর্যপ্রভাবও রয়েছে।

 

সুতারাং বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ ইতিহাস ও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংমিশ্রণের ফলে গঠিত একটি সংকর জাতি। এ জাতির মাঝে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, নেগ্রিটো, মঙ্গোলীয়, আর্য, তুর্কি, পাঠান, মোঘল, ইরানি, আরব, আবিসিনীয়, ইংরেজ, পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, দিনেমার ও আরাকানী মগদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই দীর্ঘ সংমিশ্রণের ফলে বাঙালিদের মাঝে একটি স্বকীয় দৈহিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে উঠেছে।

 

বাঙালি জাতীর দৈহিক বৈশিষ্ট্য: বাঙালির দেহ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের কারণে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত, বাঙালির মধ্যে নিম্নলিখিত দৈহিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়;

 

      গায়ের রং: কালো-বাদামি

      মাথার আকৃতি: লম্বাটে বা গোল

      চুল: কালো ও সোজা

      চোখের রং: বাদামি বা কালো

      উচ্চতা: মাঝারি

      নাসিকার আকৃতি: চওড়া বা মধ্যম

 

ভাষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ: বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জাতির প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন; অস্ট্রিক ভাষার শব্দ: "খোকা" (শিশু), "মাগো" (মা), "ডাল" (শাকসবজি বা তরকারি), "পদ্মা", "তামাক" ইত্যাদি অস্ট্রিক ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায়  এসেছে।

 

দ্রাবিড়ীয় ভাষার প্রভাব: বাংলায় দ্রাবিড় ভাষার কিছু শব্দ ও উচ্চারণগত প্রভাব রয়েছে। যেমন; "ইট", "কুঠার", "কপাল", "নাক", "তামা", "পাণ্ডু" প্রভৃতি শব্দ । এছাড়া "তাল", "চাল", "বিল" শব্দগুলোর সাথে দ্রাবিড় ভাষার  মিল রয়েছে।

 

আর্য ভাষার প্রভাব: বাংলা ভাষার একটি বড় অংশই এসেছে সংস্কৃত বা আর্য ভাষা থেকে। যেমন, "জল", "অগ্নি", "সূর্য", "দূর", "ভূমি", "গগন", "প্রাচীন", "গৃহ", "শুভ" ইত্যাদি শব্দ আর্য ভাষার অবদান।

 

টিবেটো-বর্মা ভাষার প্রভাব: পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ম্রো, প্রভৃতি জাতির ভাষায় টিবেটো-বর্মা ভাষার স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাংলার কিছু শব্দ যেমন "গরাং" (বড় ভাই), "থং" (পাহাড়ি পথ), "তং" (জলাশয়), ইত্যাদি টিবেটো-বর্মা ভাষার শব্দ ।

 

পরিশেষে বলা যায় বাঙালি জাতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গঠিত একটি সংকর জাতি। বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জাতি যেমন; অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোলীয়, তুর্কি, পাঠান, মুঘল, আরবীয়, ইউরোপীয় ইত্যাদি জাতির সংমিশ্রণ দৃশ্যমান। ফলে, বাঙালির পরিচয় শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। তবে অধিকাংশ গবেষক একমত যে, বাঙালির মধ্যে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতি গোষ্ঠীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান। 

Links

Home

Exams

Live Exam

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD