দাসপ্রথার পক্ষে এরিস্টটলের যুক্তি

দাসপ্রথার পক্ষে এরিস্টটলের যুক্তি

ভূমিকা: প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলকে “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক” বলা হয়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ Politics-এ তিনি দাসপ্রথা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। দাসপ্রথা প্রাচীন গ্রীক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এবং সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোয় এর একটি বিশেষ স্থান ছিল। এরিস্টটল দাসপ্রথাকে প্রাকৃতিক এবং সমাজের স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি দাসপ্রথাকে সমর্থন করেছেন এবং বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন।

দাসপ্রথার পক্ষে এরিস্টটলের যুক্তিগুলি:

১. প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী দাসপ্রথা: এরিস্টটলের মতে, সমাজে কিছু মানুষ প্রভু হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে এবং কিছু মানুষ দাস হিসেবে জন্মায়। তার ভাষায়, “সব কিছুতেই উত্তম কর্তৃক অধমের ওপর কর্তৃত্ব থাকবে।” এটি প্রকৃতির নিয়ম। যেহেতু মানুষ এবং জীবজগতের অনেক ক্ষেত্রেই শক্তিশালী ও দুর্বল, বুদ্ধিমান ও নির্বোধের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়, তাই দাসপ্রথাও এই প্রাকৃতিক বিধানের অংশ।

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির সম্পর্ক

২. জ্ঞান ও প্রতিভার ভিন্নতা: এরিস্টটল যুক্তি দেন যে, সমাজে কিছু মানুষ প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধির জন্য জন্মায়, যারা নেতৃত্ব দিতে পারে এবং আদেশ প্রদান করতে সক্ষম। অন্যদিকে, কিছু মানুষ জন্মগতভাবে শারীরিক পরিশ্রমের জন্য উপযুক্ত এবং তারা শুধু কাজ করার জন্যই যোগ্য। যারা আদেশ দিতে সক্ষম নয়, তাদের জন্য দাসত্বই প্রয়োজনীয় এবং যৌক্তিক।

3. দাস হচ্ছে সম্পদ: এরিস্টটল দাসদের সম্পদের এক ধরনের হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তার মতে, গৃহের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা সম্পদ বলতে যা কিছু বোঝায়, তার মধ্যে দাসও অন্তর্ভুক্ত। দাসরা সজীব সম্পদ, যারা প্রভুর আদেশ মেনে শারীরিক পরিশ্রম করে। তাদের ছাড়া প্রভুদের জীবনযাপন সম্ভব নয়, কারণ তারা সংসারের প্রয়োজনীয় কাজগুলি সম্পন্ন করে।

৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা: এরিস্টটলের মতে, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য দাসপ্রথা অপরিহার্য। প্রভুরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক কাজে ব্যস্ত থাকতে পারে কারণ দাসরা তাদের সংসারের দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করে দেয়। এর ফলে প্রভুরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়, এবং দাসদের শারীরিক পরিশ্রমের ফলে রাষ্ট্র পরিচালনা সহজ হয়।

আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

৫. দাসদের জন্য দাসত্ব যৌক্তিক ও কল্যাণকর: এরিস্টটল মনে করেন, দাসত্ব দাসদের জন্য উপকারী। যেহেতু দাসদের মানসিক এবং নৈতিক জ্ঞান সীমিত, তারা প্রভুর অধীনে কাজ করলে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা, সংযম এবং আদর্শ চরিত্র গড়ে ওঠে। দাসরা প্রভুর নেতৃত্বে থেকে সামাজিক নিয়ম-কানুন শিখে নিজেদের উন্নয়ন সাধন করতে পারে।

৬. নাগরিকদের সুবিধার্থে দাসপ্রথা: দাসরা প্রভুদের জন্য সংসারের সকল দৈহিক শ্রমমূলক কাজ সম্পন্ন করে। এর ফলে প্রভুরা কাজের ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে রাষ্ট্রের শাসন, রাজনীতি এবং দর্শনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারে। এরিস্টটলের মতে, এই ব্যবস্থা প্রভুদের মনের বিকাশে সহায়ক।

৭. কর্মের সমন্বয় সাধন: এরিস্টটল মনে করেন, প্রভুদের আদেশ অনুযায়ী দাসরা শারীরিক পরিশ্রম করে রাষ্ট্রের কার্যক্রম সম্পন্ন করে। প্রজ্ঞাবান প্রভুরা আদেশ দেন এবং দাসরা সেগুলো শারীরিকভাবে সম্পাদন করে। এর ফলে কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটে।

৮. দাসদের শ্রেণী বিভাগ: এরিস্টটল দাসদের দু’টি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করেছেন:

১. প্রকৃতিগত দাস: যারা জন্মগতভাবে দাসত্বের জন্য উপযুক্ত।

২. আইনগত দাস: যারা যুদ্ধবন্দী বা অন্য কোনো কারণে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। এই দাসত্বকে আইনীভাবে স্বীকৃত করা হয়েছে এবং তাদেরও প্রভুদের অধীনে থাকার যৌক্তিকতা রয়েছে।

আরো পড়ুনঃ ম্যাকিয়াভেলীবাদ কি? ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? 

উপসংহার: এরিস্টটলের দাসপ্রথা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি তার সময়ের সামাজিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। যদিও আধুনিক সমাজে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, এরিস্টটলের যুক্তিগুলি সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে ব্যাখ্যা করার জন্য ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজকের সমাজে দাসপ্রথা নেই, তবে শাসক এবং শাসিতদের মধ্যে সামাজিক বিভেদ এখনও বিদ্যমান। এরিস্টটলের দাসপ্রথার ধারণা মানব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, যদিও আধুনিক মূল্যবোধ অনুযায়ী তা অগ্রহণযোগ্য।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263