আইনসভা কি? আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো আইনসভা। আইনসভা সরকারের সেই বিভাগ, যা আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু পরিচালনায় সহায়তা করে। এটি জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এবং নাগরিকদের ইচ্ছা ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। শাসন বিভাগ ও অন্যান্য প্রভাবশালী সংস্থার কারণে আইনসভা তার পূর্বের গৌরব অনেকটাই হারিয়েছে।
আইনসভার সংজ্ঞা: আইনসভা হলো একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, যা আইনের প্রণয়ন, সংশোধন এবং পরিবর্তনের দায়িত্ব পালন করে। এটি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং রাষ্ট্রের আইনগত কাঠামোকে সুষ্ঠু করতে সহায়তা করে।
Oxford Dictionary অনুসারে, “আইনসভা হলো এমন একদল মানুষের সমষ্টি, যারা আইন প্রণয়ন এবং পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে।”
টকভিল বলেছেন, “আইনসভা হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে জনগণের প্রাধান্য থাকে।”
আরো পড়ুনঃ জাতি ও জাতীয়তাবাদ কাকে বলে?
আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ:
১. আইন প্রণয়নে শিথিলতা: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভা তার প্রাথমিক ক্ষমতা হারাচ্ছে। বেশিরভাগ আইন শাসন বিভাগ থেকে প্রস্তাবিত হয়, এবং আইনসভা কেবল দলীয় নির্দেশ অনুসারে সেগুলো অনুমোদন করে। এতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।
২. দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা: দলীয় ব্যবস্থা এবং নির্দেশের কঠোরতা আইনসভার সদস্যদের স্বাধীনতা সীমিত করেছে। শাসক দলের সদস্যরা দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রেখে কাজ করে এবং দলীয় আদেশ মেনে চলতে বাধ্য হন। ফলে আইনসভা দলীয় চাপের কারণে তাদের স্বাধীন বিবেচনা হারায়।
৩. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, যেমন অর্থনৈতিক সংকট, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। শাসন বিভাগ এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় প্রধান ভূমিকা পালন করে, ফলে আইনসভার গুরুত্ব কমে যায়।
৪. সদস্যদের অযোগ্যতা: অনেক ক্ষেত্রে আইনসভার সদস্যদের যোগ্যতার অভাবও এর ক্ষমতা হ্রাসের কারণ। অযোগ্য এবং অদক্ষ প্রতিনিধিরা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়, যা আইনসভার প্রভাবকে সীমিত করে।
৫. জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব: জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব শাসন বিভাগের প্রতি বেশি আগ্রহী। শাসন বিভাগ সক্রিয়ভাবে জনগণের সেবা দেয়ার কারণে জনগণের মধ্যে শাসন বিভাগের প্রভাব বাড়ে, যা আইনসভার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়।
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
৬. আইনসভার সদস্যদের গুণগত মানের অবনতি: আইনসভার সদস্যদের গুণগত মানের অবনতি আইনসভাকে দুর্বল করেছে। এর ফলে আইনসভায় একঘেয়েমি ও অর্থহীন বিতর্কের প্রসার ঘটেছে, যা জনগণের কাছে আইনসভার গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে।
৭. স্বার্থগোষ্ঠীর সাথে যোগসূত্রের অভাব: স্বার্থগোষ্ঠীগুলো সরকারের কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, কিন্তু আইনসভা এই গোষ্ঠীগুলোর সাথে কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আইনসভার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
৮. ক্ষমতার লোভ: আইনসভার সদস্যরা অনেক সময় ক্ষমতার লোভে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থে বেশি মনোযোগী হয়। এতে আইনসভার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।
৯. জরুরি অবস্থায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতা: জরুরি অবস্থায় আইনসভা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। আইন প্রণয়নের জটিল প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘ সময়ের কারণে জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় আইনসভা দুর্বল।
১০. অর্পিত ক্ষমতার ব্যবহার: অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন শাসন বিভাগের হাতে চলে যাওয়ায় আইনসভার ক্ষমতা আরও কমে গেছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে শাসন বিভাগ অনেক সময় আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা অর্জন করে।
১১. আলোচনার সুযোগের অভাব: আইনসভায় প্রস্তাবিত কোনো বিষয় নিয়ে সমালোচনার সুযোগ কম। বিরোধী দল অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
১২. আইনসভার সদস্যদের স্বার্থপরতা: আইনসভার সদস্যরা অনেক সময় নিজেদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেশি আগ্রহী থাকে। এ কারণে তারা জনস্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, যা আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ।
১৩. গণসংযোগের অভাব: আইনসভার সদস্যরা জনগণের সাথে নিবিড় সংযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। শাসন বিভাগ জনগণের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকায় আইনসভার প্রভাব কমে গেছে।
১৪. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অভাব: সরকারের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো অত্যন্ত জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আইনসভার সদস্যদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো শাসন বিভাগের হাতে চলে যায়।
আরো পড়ুনঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
উপসংহার: আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, শাসন বিভাগের প্রভাব এবং দলের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এর মূল কারণ। এছাড়া সদস্যদের অযোগ্যতা, জনসাধারণের মনোভাব, অর্থনৈতিক সংকট এবং স্বার্থগোষ্ঠীর ভূমিকা আইনসভার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। তবে, আইনসভার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সদস্যদের দক্ষতা, জনসংযোগ, এবং দলীয় শৃঙ্খলার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।